দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে 'ডার্ক ট্রায়াড' মানসিকতার ছাত্ররা, যেমন সাইকোপ্যাথি এবং আত্ম-প্রেমের অধিকারী, পড়াশোনায় শর্টকাট নেওয়ার জন্য এআই সরঞ্জামগুলির অপব্যবহার করে। তারা ChatGPT-এর মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে এবং সেগুলোকে নিজেদের বলে চালায়।
এআই: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) আমাদের জগৎকে যেভাবে দ্রুত পরিবর্তন করেছে, তা এখন শিক্ষার ক্ষেত্রেও নতুন নতুন পরীক্ষার অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এআই কি কেবল শিক্ষার একটি মাধ্যম, নাকি এটি এখন 'শর্টকাট' নেওয়ার একটি নতুন উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই গুরুতর প্রশ্নটি নিয়ে সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকরা গভীরভাবে গবেষণা করেছেন এবং যে ফলাফলগুলি সামনে এসেছে, তা কেবল চমকপ্রদই নয়, বরং শিক্ষার নৈতিকতার উপরেও একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে।
BMC Psychology-এ প্রকাশিত গবেষণাটি কী বলছে?
এই গবেষণাটি বিখ্যাত জার্নাল BMC Psychology-এ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে চীনের ৫০০ জনের বেশি আর্ট শিক্ষার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, কোন মানসিক এবং সামাজিক কারণগুলির কারণে ছাত্ররা এআই-এর অপব্যবহার করছে তা খুঁজে বের করা। ফলাফলে দেখা গেছে যে 'ডার্ক ট্রায়াড' ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছাত্ররা – অর্থাৎ যারা সাইকোপ্যাথি, নার্সিসিজম এবং ম্যানিপুলেটিভ চিন্তা করে – তারা এআই-কে শর্টকাট হিসাবে ব্যবহার করছে।
কলা শিক্ষায় কেন এআই-এর অপব্যবহার হচ্ছে?
গবেষণায় আর্ট সম্পর্কিত ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র – যেমন, পেইন্টিং, সঙ্গীত, থিয়েটার এবং নাচের শিক্ষার্থীরা – অংশ নিয়েছিল। এই ছাত্রদের মধ্যে দেখা গেছে যে, যারা মানসিকভাবে নিজেদের সবচেয়ে বেশি বিশেষ মনে করে বা অন্যদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারদর্শী, তারা তাদের অ্যাসাইনমেন্ট এবং প্রকল্পগুলি ChatGPT এবং Midjourney-এর মতো এআই সরঞ্জাম ব্যবহার করে তৈরি করেছে এবং সেগুলোকে নিজেদের মৌলিক কাজ হিসাবে পেশ করেছে। এটি কেবল শিক্ষাগত অসততা নয়, বরং এটি দেখায় যে কীভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার ছাত্রদের মানসিক আচরণের সঙ্গে জড়িত।
প্রোক্রাস্টিনেশন এবং পারফরম্যান্সের চাপও কারণ
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, যে সকল ছাত্রদের মধ্যে প্রোক্রাস্টিনেশন বা 'কাজ ফেলে রাখার' অভ্যাস ছিল, অথবা যারা নম্বর এবং ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত চাপে থাকত, তারাও এআই-এর অপব্যবহার করছিল। যখন সময় কম থাকে, পরিশ্রম করার ইচ্ছা থাকে না এবং মানসিক চাপ থাকে – তখন এআই তাদের জন্য একটি সহজ, দ্রুত সমাধান সরবরাহকারী সরঞ্জাম হয়ে ওঠে।
খ্যাতি এবং পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষা একটি কারণ
এই গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল যে, যে ছাত্রদের প্রেরণা কেবল পুরস্কার, স্বীকৃতি বা বস্তুগত সাফল্য ছিল, তারা এআই-কে সবচেয়ে বেশি শর্টকাট হিসাবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, ছাত্রদের মধ্যে নৈতিক মূল্যের পরিবর্তে ফল-কেন্দ্রিক চিন্তা প্রাধান্য পাচ্ছে।
'ডার্ক ট্রায়াড' ব্যক্তিত্ব: এআই-এর অপব্যবহারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক
গবেষণায় যে ছাত্রদের মানসিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে 'ডার্ক ট্রায়াড' নামক লক্ষণগুলি দেখা গেছে। এর মধ্যে তিনটি প্রধান মানসিক বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত:
- সাইকোপ্যাথি – অপরাধবোধের অভাব, আবেগগত দূরত্ব
- নার্সিসিজম – আত্ম-প্রেম এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা
- ম্যাকিয়াভেলিয়ান চিন্তা – মানুষকে ম্যানিপুলেট করার প্রবণতা
এই ধরনের ছাত্ররা ChatGPT এবং Midjourney-এর মতো এআই সরঞ্জাম ব্যবহার করে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট এবং প্রকল্পগুলি তৈরি করছে এবং সেগুলোকে নিজেদের কাজ বলে জমা দিচ্ছে।
গবেষকদের সতর্কতা: শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন উপায় গ্রহণ করতে হবে
এই গবেষণার লেখক – জিনয়ি সং (Chodang University) এবং শুয়ান লিউ (Baekseok University) – মনে করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এখন এআই-এর প্রেক্ষাপটে নতুন কৌশল তৈরি করতে হবে। তাদের পরামর্শের মধ্যে রয়েছে:
- এমন অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা হোক যা এআই থেকে কপি করা কঠিন
- ছাত্রদের নৈতিকতা এবং ডিজিটাল সততা সম্পর্কে সচেতন করা হোক
- এআই-এর সঠিক ও ভুল ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করা হোক
এআই: আশীর্বাদ নাকি চ্যালেঞ্জ? শিক্ষা জগতের জন্য নতুন চিন্তাভাবনার প্রয়োজন
এআই প্রযুক্তি বর্তমানে পড়াশোনাকে সহজ এবং আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করছে, তবে এর সঙ্গে এটি নৈতিক এবং মূল্যবোধগত সংকটও তৈরি করছে। এআই থেকে ছাত্ররা শিখতে পারে, তবে যদি এর ব্যবহার কেবল নকল এবং প্রতারণার জন্য হয়, তবে এটি শিক্ষার উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেয়।