আব্রাহাম লিংকন – এই নাম আজও বিশ্বের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী এবং মহান নেতাদের মধ্যে গণ্য করা হয়। এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া লিংকন তাঁর দৃঢ় সংকল্প, ন্যায়পরায়ণ চিন্তা এবং মানবতার জন্য করা সংগ্রাম দ্বারা শুধু আমেরিকাকেই নয়, সারা বিশ্বকে শিখিয়েছেন কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতেও সাহস ও সত্যের পথে চলে সমাজে বড় পরিবর্তন আনা যায়।
শৈশব এবং সংগ্রামের সূচনা
আব্রাহাম লিংকনের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯ সালে, আমেরিকার কেন্টাকি রাজ্যের এক দরিদ্র পরিবারে। তাঁর বাবা-মা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং শৈশবে লিংকনকে অনেক দারিদ্র্য ও কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৯ বছর, তখনই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়, যা তাঁর জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। তিনি ভালোভাবে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি, তবে তিনি স্ব-উদ্যোগে পড়াশোনা করেন এবং বই থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। লিংকনের শৈশব আমাদের শেখায় যে, যদি কিছু করে দেখানোর জেদ থাকে, তবে কোনো বাধাই পথের কাঁটা হতে পারে না।
আত্মনির্ভরতা এবং শিক্ষার আগ্রহ
আব্রাহাম লিংকনের জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যদি আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং পড়াশোনার আগ্রহ থাকে, তবে কোনো গন্তব্যই দূরে নয়। তিনি দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু হার মানেননি। তিনি বই ধার করে, চিমনি আলোয় গভীর রাত পর্যন্ত পড়তেন। তিনি আইনের কঠিন বইগুলি নিজে পড়ে বুঝেছিলেন এবং কোনো সাহায্য ছাড়াই আইনজীবী হয়েছিলেন। তাঁর এই একাগ্রতা এবং শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তাঁকে 'প্রেইরি আইনজীবী'র মতো সম্মান এনে দিয়েছিল।
আইন থেকে রাজনীতির পথ
আব্রাহাম লিংকন আইনজীবী হিসাবে কাজ করার সময় রাজনীতিতে আগ্রহী হন। তিনি প্রথমে ইলিনয় রাজ্যের বিধানসভায় প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন এবং পরে আমেরিকার সংসদে (প্রতিনিধি সভা) নির্বাচিত হন। প্রথমে তিনি হুইগ পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু যখন দেশে দাসত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তিনি রিপাবলিকান পার্টির অংশ হয়ে সমাজে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেন। দাসত্ব দূর করা এবং সমাজকে সাম্যের দিকে নিয়ে যাওয়া তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে।
দাসত্বের বিরুদ্ধে আওয়াজ এবং রাষ্ট্রপতি হওয়া
আমেরিকাতে সেই সময়ে দাসত্ব একটি সাধারণ প্রথা ছিল, কিন্তু লিংকন এর বিরোধিতা করতেন। তিনি ১৮৫৮ সালে স্টিফেন ডগলাসের সাথে বিখ্যাত বিতর্কে অংশ নেন এবং দাসত্বের বিরুদ্ধে তাঁর ধারণা দিয়ে জনগণের মন জয় করেন। এরপরে, ১৮৬০ সালে তিনি আমেরিকার ১৬তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার ফলে দক্ষিণের রাজ্যগুলি ভয় পেতে শুরু করে যে দাসত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এবং এই ভয় আমেরিকাকে গৃহযুদ্ধের আগুনে ফেলে দেয়।
মার্কিন গৃহযুদ্ধ এবং লিংকনের নেতৃত্ব
১৮৬১ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যেখানে লিংকন কেবল ফেডারেল রাজ্যগুলিকে একত্রিত করেননি, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি দাসত্ব বিলুপ্ত করার দিকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১লা জানুয়ারি ১৮৬৩ সালে তিনি ‘মুক্তি ঘোষণা’ (Emancipation Proclamation) জারি করেন, যেখানে তিনি বিদ্রোহী রাজ্যগুলিতে সমস্ত দাসদের মুক্ত ঘোষণা করেন। এই পদক্ষেপ আমেরিকার ইতিহাসে মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল।
গেটিসবার্গ ভাষণ এবং নতুন চিন্তা
১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে লিংকন বিখ্যাত ‘গেটিসবার্গ ভাষণ’ দেন, যা আজও গণতন্ত্রের মহান সংজ্ঞা হিসাবে বিবেচিত হয় – ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার’। এই ভাষণ সেই সময়ের জন্যেই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। লিংকন দেখিয়েছিলেন যে, সত্যিকারের নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতায় থেকে শাসন করা নয়, বরং মানুষের আত্মার সাথে সংযোগ স্থাপন করে সমাজকে নতুন দিশা দেওয়া।
যে শেষের শুরু অমরত্বের
১৪ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে, গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরেই, যখন লিংকন ওয়াশিংটন ডি.সি.-র ফোর্ড থিয়েটারে একটি নাটক দেখতে গিয়েছিলেন, তখন একজন দক্ষিণপন্থী অভিনেতা জন উইলక్స్ বুথ তাঁকে হত্যা করেন। ১৫ এপ্রিল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই ঘটনাটি আমেরিকা এবং সারা বিশ্বের জন্য গভীর শোকের কারণ হয়েছিল। কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর নীতি এবং তাঁর উত্তরাধিকার আজও জীবিত আছে।
উত্তরাধিকার যা আজও অনুপ্রেরণা
আব্রাহাম লিংকন শুধু আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না, বিশ্ব ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ, সহানুভূতিশীল এবং দূরদর্শী নেতাদের মধ্যে একজন হিসাবেও গণ্য হন। তিনি তাঁর জীবন থেকে শিখিয়েছেন যে:
- নেতৃত্ব কেবল পদ নয়, দায়িত্ব।
- সত্যিকারের গণতন্ত্র সাম্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত।
- শিক্ষা, পরিশ্রম এবং নৈতিকতা যে কোনও মানুষকে মহান করতে পারে।
আব্রাহাম লিংকনের জীবন আমাদের সকলের জন্য একটি অনুপ্রেরণা – বিশেষ করে তাঁদের জন্য যারা কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন, যাঁরা সাহস হারিয়েছেন, বা যাঁরা মনে করেন তাঁদের সম্পদের অভাব রয়েছে। লিংকন দেখিয়েছেন যে, যদি আপনার মধ্যে সততা, সেবা এবং সাহস থাকে, তবে আপনি কেবল নিজেকেই নয়, পুরো সমাজকেও পরিবর্তন করতে পারেন।