একলিঙ্গজী মন্দির: ইতিহাস, স্থাপত্য এবং ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ

একলিঙ্গজী মন্দির: ইতিহাস, স্থাপত্য এবং ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ

উদয়পুরের একলিঙ্গজী মন্দির শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্দির রাজপুতদের কুলদেবতা হিসেবে প্রসিদ্ধ এবং এটি মহারানা প্রতাপের মতো বীরদের সাথে জড়িত ঐতিহ্যের কেন্দ্রস্থল। স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যে এর জাঁকজমক এটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে।

Eklingji Temple: ভারতে ধর্মীয় স্থানের প্রাচুর্য রয়েছে, তবে কিছু মন্দির এমনও আছে যা কেবল ধর্মীয় গুরুত্বই রাখে না, বরং তাদের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের জন্যও বিখ্যাত। রাজস্থানের উদয়পুর জেলায় অবস্থিত একলিঙ্গ মন্দির চত্বর এমনই বিশেষ মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। এই মন্দিরটি তার বিশাল স্থাপত্য, ঐতিহাসিক ঘটনা এবং রাজপুত ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত।

একলিঙ্গের ইতিহাস ও স্থান

একলিঙ্গ মন্দির উদয়পুর শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এটি দুটি পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত একটি স্থান, যা প্রাচীনকালে কৈলাসপুরী নামে পরিচিত ছিল। তবে এখানকার জাঁকজমকপূর্ণ শিব মন্দিরের কারণে এটি ধীরে ধীরে একলিঙ্গজী নামে পরিচিত হতে শুরু করে। ভগবান শিবের এই মূর্তি মেওয়ার রাজ্যের মহারানাদের এবং অন্যান্য রাজপুতদের কুলদেবতা হিসেবে বিবেচিত হত।

এমন বিশ্বাস করা হয় যে মেওয়ারের রাজারা তাদের শাসনকালে কেবল ভগবান একলিঙ্গকেই প্রকৃত শাসক মানতেন। এই কারণেই উদয়পুরের মহারানাকে 'দেওয়ান' উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগে মহারানার এই পরম্পরা ছিল যে তিনি একলিঙ্গজীর পূজা অর্চনা করে আশীর্বাদ নেবেন।

ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই মন্দির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অনেক ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি এবং প্রতিজ্ঞা নেওয়া হয়েছে। কথিত আছে যে মহারানা প্রতাপ তাঁর কঠিন পরিস্থিতিতে এবং বিরোধীদের মাঝেও একলিঙ্গজীকে সাক্ষী মেনে অনেক পণ করেছিলেন। এমন বিশ্বাস করা হয় যে যখন তাঁর সাহসের উপর সংকট এসেছিল, তখনও তিনি আকবরের দরবারে উপস্থিত থেকে নিজের গৌরব এবং সম্মান রক্ষা করেছিলেন।

স্থাপত্য এবং কারুকার্য

একলিঙ্গ মন্দিরের স্থাপত্য অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এবং আকর্ষণীয়। এটি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং এর ভিতরে ১০৮টি মন্দির রয়েছে। প্রধান মন্দিরে ভগবান শিবের চতুর্মুখী মূর্তি স্থাপিত আছে, যার উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট।

এই চার মুখের মূর্তিটি চারটি দিকের দিকে মুখ করে আছে। এই চারটি মুখের প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে:

  • উত্তর দিকে বিষ্ণু,
  • পূর্বে সূর্য,
  • দক্ষিণে রুদ্র,
  • পশ্চিমে ব্রহ্মা।

মন্দিরের প্রধান দরজায় শিবের বাহন নন্দী ষাঁড়ের পিতলের মূর্তি স্থাপিত আছে। মন্দির চত্বরে দেবী পার্বতী এবং ভগবান গণেশের প্রতিমাও অবস্থিত। যমুনা এবং সরস্বতীর মূর্তিগুলিও মন্দিরের ভিতরে দেখা যায়।

বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র হল রূপার শিবলিঙ্গ, যা রূপালী সাপ দিয়ে ঘেরা। এর সাথে মন্দিরের রূপালী দরজাগুলিতে ভগবান গণেশ এবং ভগবান কার্তিকের চিত্রাঙ্কন করা আছে। এখানে নৃত্যরত নারীদের সুন্দর মূর্তিগুলিও দেখা যায়। মন্দির চত্বরে গণেশজী মন্দির, অম্বা মাতা মন্দির, নাথদের মন্দির এবং কালিকা মন্দিরও অবস্থিত। প্রতিটি মন্দিরের নির্মাণ এবং স্থাপত্যকলা নিজের মধ্যে অনন্য।

মন্দির নির্মাণ ও বিকাশ

একলিঙ্গ মন্দিরের নির্মাণকাল এবং এর নির্মাতা সম্পর্কে স্পষ্ট লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি অনুসারে, এই মন্দিরটি বপ্পা রাওয়াল অষ্টম শতাব্দীতে নির্মাণ করেছিলেন। পরে মন্দিরটি ভেঙে গেলে মহারানা মোকল এটির পুনর্নির্মাণ করান। বর্তমান রূপের কৃতিত্ব মহারানা রায়মলকে দেওয়া হয়।

মহারানা রায়মল কালো মার্বেল দিয়ে নির্মিত চতুর্মুখী শিব মূর্তি স্থাপন করেন। মন্দিরের দক্ষিণ দিকের দরজার কাছে তাঁর সম্পর্কিত ১০০টি শ্লোক খোদাই করা আছে। এইভাবে এই স্থানটি কেবল ধর্মীয় নয়, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

চত্বরের বৈশিষ্ট্য

মন্দিরের চার দেওয়ালের ভিতরে অনেক ছোট ছোট মন্দির আছে। এর মধ্যে একটি বিষ্ণু মন্দির, যা মহারানা কুম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। এটি লোকেরা মীরাবাঈয়ের মন্দিরও বলে।

কিছু দূরে লকুলীশ মন্দির আছে, যা বিক্রম সংবত ১০২৮ (ঈ.সন ৯৭১)-এ মঠাধ্যক্ষ দ্বারা স্থাপন করা হয়েছিল। এছাড়াও বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দিরও মন্দির চত্বরে অবস্থিত।

মন্দিরের महंतদের ইতিহাসও আকর্ষণীয়। জনশ্রুতি অনুসারে বপ্পা রাওয়ালের গুরু নাথ হারীতরাশি মন্দিরের महंत ছিলেন। তাঁর অনুগামীরা মন্দিরের পূজা এবং অন্যান্য ধর্মীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। পরে মঠাধ্যক্ষদের আচরণ भ्रष्ट হলে মন্দিরের দেখাশোনা গোঁসাইদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই পরম্পরা আজও চলছে।

ধর্মীয় তাৎপর্য ও ঐতিহ্য

একলিঙ্গ মন্দির কেবল স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত পূজনীয়। মেওয়ারের রাজপুতরা এটিকে সর্বদা নিজেদের রক্ষা এবং শাসনের ভিত্তি মনে করত। যুদ্ধ এবং সংকটের সময় মহারানা প্রতাপ সহ অন্যান্য রাজারা এখানে এসে নিজেদের শক্তি এবং ধৈর্যের জন্য প্রার্থনা করতেন।

মন্দির চত্বরে প্রতি বছর অনেক উৎসব ও মেলা আয়োজিত হয়। শিবরাত্রি এখানে বিশেষভাবে জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। এই উপলক্ষে ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসেন।

একলিঙ্গ মন্দির ও সমাজ

একলিঙ্গ মন্দির সমাজ এবং সংস্কৃতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি কেবল ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রতীকও। মহারানা রায়মল এবং অন্যান্য রাজাদের নীতি, তাঁদের সংগ্রাম এবং ধর্মের প্রতি বিশ্বাস আজও মন্দির চত্বরে জীবিত আছে।

মন্দির চত্বরের স্থাপত্য এবং মূর্তিগুলির বৈচিত্র্য প্রমাণ করে যে প্রাচীন রাজস্থানে শিল্প এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের এক अद्भुत संगम ছিল। এখানকার মূর্তি, চিত্রকর্ম এবং স্থাপত্য ভারতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধির প্রতীক।

একলিঙ্গজী মন্দির কেবল উদয়পুর এবং মেওয়ারের ধর্মীয় পরিচয় নয়, এটি রাজস্থানের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যেরও প্রতীক। এখানকার भव्य স্থাপত্য, चतुর্মুখী शिवलिंग এবং বিভিন্ন মন্দিরের উপস্থিতি এটিকে ভক্ত এবং ইতিহাস প্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ স্থান করে তুলেছে। মহারানা প্রতাপ এবং মেওয়ারের রাণাদের সাথে জড়িত ঘটনাগুলি এই মন্দিরকে কেবল ধর্মীয়ই নয়, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। 

Leave a comment