গুগলের অ্যান্ড্রয়েড আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম ২০২৩ সালের তুরস্কের ভূমিকম্পে সঠিক সতর্কতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ দুর্বল 'বি অ্যাওয়্যার' অ্যালার্ট পেয়েছে, যার ফলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গুগল তাদের ভুল স্বীকার করে সিস্টেমটি উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে তুরস্ক এবং উত্তর সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন একটি চমকপ্রদ তথ্য সামনে এসেছে — গুগলের অ্যান্ড্রয়েড আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম (এইইএ) এই ভূমিকম্পের সময় সঠিক সময়ে মানুষকে সতর্ক করতে ব্যর্থ হয়েছে। গুগল এই ভুল স্বীকার করেছে এবং জানিয়েছে যে সিস্টেমের কারিগরি ত্রুটির কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে সময় মতো 'টেক অ্যাকশন' অ্যালার্ট পৌঁছায়নি।
কীভাবে ব্যর্থ হল গুগলের আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম?
গুগলের অ্যান্ড্রয়েড আর্থকোয়েক অ্যালার্ট সিস্টেম মোবাইল ফোনে থাকা সেন্সরের মাধ্যমে পৃথিবীর কম্পন শনাক্ত করে ব্যবহারকারীদের ভূমিকম্প আসার আগে সতর্ক করার দাবি করে।
কিন্তু তুরস্কের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে, যার মাত্রা ছিল ৭.৮, সিস্টেমটি কম্পনের তীব্রতা কম করে দেখেছে। গুগল অনুসারে:
- মাত্র ৪৬৯টি 'টেক অ্যাকশন' অ্যালার্ট পাঠানো হয়েছে, যেখানে সেই অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি মানুষ ছিল।
- প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ শুধুমাত্র 'বি অ্যাওয়্যার' অ্যালার্ট পেয়েছে, যা হালকা কম্পনের জন্য হয়ে থাকে এবং এই অ্যালার্ট ফোনকে জোরে বাজায় না এবং ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ মোডকেও ওভাররাইড করে না।
- এ কারণে অধিকাংশ মানুষ সময় মতো সচেতন হতে পারেনি।
অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক এইইএ সিস্টেম কীভাবে কাজ করে?
এইইএ সিস্টেমে মোবাইল ফোনের সেন্সর (যেমন অ্যাক্সেলেরোমিটার এবং জাইরোস্কোপ) পৃথিবীর কম্পন অনুভব করে। যখন কম্পন একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে, তখন এই ডেটা গুগলের সার্ভারে পাঠানো হয়। সার্ভারে একটি অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে যে ভূমিকম্প হয়েছে কিনা এবং তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারকারীদের কাছে অ্যালার্ট পাঠায়। তুরস্কে ৭০% এর বেশি মোবাইল ফোন অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও এই সিস্টেমটি তার পুরো ক্ষমতা দিয়ে কাজ করতে পারেনি।
গুগলের অ্যালগরিদম কেন ভুল তথ্য দিয়েছে?
গুগলের অ্যালগরিদম প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্পের তীব্রতা ৪.৫ থেকে ৪.৯ এর মধ্যে অনুমান করছিল, যা প্রকৃত ৭.৮ থেকে অনেক কম ছিল। এই ভুল মূল্যায়নের কারণে অ্যালার্টের স্তর 'বি অ্যাওয়্যার' পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, যা সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট দুর্বল ছিল। এই ঘটনার পরে কয়েক মাসের তদন্তে এটিও পাওয়া গেছে যে, ওই অঞ্চলে থাকা কোনো ব্যক্তি 'টেক অ্যাকশন' অ্যালার্ট পায়নি।
গুগল কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
গুগল এই ভুল স্বীকার করে বলেছে যে তারা প্রতিটি ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের সিস্টেমকে ক্রমাগত উন্নত করছে।
- পরে যখন তারা একই ভূমিকম্পের সিমুলেশন পুনরায় চালায়, তখন সিস্টেমটি আনুমানিকভাবে ১ কোটি 'টেক অ্যাকশন' এবং ৬.৭ কোটি 'বি অ্যাওয়্যার' অ্যালার্ট পাঠাত।
- দ্বিতীয় কম্পনের (৭.৫ তীব্রতা) সময়, সিস্টেমটি আরও ভালোভাবে কাজ করেছে এবং ৮,১৫৮টি 'টেক অ্যাকশন' এবং প্রায় ৪০ লক্ষ 'বি অ্যাওয়্যার' অ্যালার্ট পাঠানো হয়েছিল।
এই সিস্টেমটি এখন মোট ৯৮টি দেশে সক্রিয় আছে, এবং গুগল দাবি করে যে তুরস্কের দুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে সিস্টেমটিকে আপগ্রেড করা হয়েছে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এইইএ সিস্টেমের ভূমিকা
গুগলের এইইএ একটি বিপ্লবী প্রযুক্তি যা মোবাইল ফোনের সেন্সর ডেটা ব্যবহার করে ভূমিকম্পের প্রাথমিক সতর্কতা প্রদান করে। এর আগে এই ধরনের অ্যালার্ট সিস্টেম বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি সংস্থার কাছে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু গুগল এটিকে সাধারণ জনগণের জন্য উপলব্ধ করেছে। তবে, তুরস্কে হওয়া এই ব্যর্থতা এই প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং জটিলতাও সামনে এনেছে।
ভারতের জন্য শিক্ষা: প্রস্তুত থাকুন, তবে প্রযুক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করবেন না
ভারত একটি ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তর ভারত, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং হিমালয় অঞ্চল। এমতাবস্থায়:
- শুধু প্রযুক্তির ওপর নির্ভর না করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং লোক সচেতনতার ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
- স্থানীয় স্তরে সাইরেন, টিভি, রেডিও, এসএমএস অ্যালার্ট সিস্টেম এবং কমিউনিটি প্রশিক্ষণ তৈরি করতে হবে।
- মোবাইল কোম্পানি এবং সরকারকে একসঙ্গে একটি হাইব্রিড অ্যালার্ট সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যা প্রযুক্তিগত এবং মানবিক উভয় পদ্ধতির মিশ্রণ হবে।