আজকের দ্রুতগতির জীবনে আমরা প্রায়শই নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ি। কাজের চাপ, মানসিক চাপ এবং মোবাইল ও ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের ঘুম সবচেয়ে আগে প্রভাবিত হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন, শুধু কম ঘুম নয়, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘুমানোও আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে? আসুন জেনে নিই ঘুম এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক কী এবং কেন ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমানো আপনার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
সঠিক ঘুম কেন জরুরি?
ঘুম আমাদের শরীরের সেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যেখানে শরীর এবং মস্তিষ্ক উভয়ই নিজেকে মেরামত করে। রাতে ঘুমানোর সময় আমাদের শরীর নতুন কোষ তৈরি করে, মস্তিষ্কে জমা বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। তাই, নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। এতে শরীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় এবং পরের দিন সকালে এনার্জিতে ভরপুর মনে হয়।
কম ঘুমের ক্ষতি: স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব
আজকাল অনেক মানুষ ৭ ঘণ্টারও কম ঘুমোন। এই অভ্যাস সরাসরি স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। ঘুমের অভাবে শরীরের বিপি, সুগার এবং হরমোন ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। এর ফলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা এবং মানসিক চাপের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদি আপনি ক্রমাগত কম ঘুমান, তাহলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে সংক্রমণ এবং রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ২৪ ঘণ্টার বেশি জেগে থাকলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা প্রভাবিত হয়, একাগ্রতা কমে যায় এবং মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়।
৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমের বিপদ: সত্যিই কি বেশি ঘুম ক্ষতিকর?
সাধারণত এটা মনে করা হয় যে, যত বেশি ঘুম তত ভালো স্বাস্থ্য। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, যারা প্রতিদিন ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমোন, তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৪% পর্যন্ত বেড়ে যায়। এর মানে হল, বেশি ঘুমানোও স্বাস্থ্যের জন্য ততটাই বিপজ্জনক হতে পারে, যতটা কম ঘুমানো। এই বেশি ঘুমের বিপদ অনেক কারণে হয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘুমানোর ফলে শরীরের পেশী দুর্বল হয়ে যেতে পারে, স্থূলতা বাড়তে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই, অতিরিক্ত ঘুমও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।
ঘুম এবং মানসিক স্বাস্থ্য: গভীর সম্পর্ক
ঘুম আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। যখন ঘুম পুরো হয় না, তখন মানসিক চাপ, উদ্বেগ, হতাশার মতো সমস্যা বাড়ে। সেই সাথে মস্তিষ্কের চিন্তা করার ও বোঝার ক্ষমতা কমে যায়। ঘুম কম হলে মুড সুইং, খিটখিটে মেজাজ এবং নেতিবাচক চিন্তা বেড়ে যায়। অন্যদিকে, সঠিক ঘুম হলে মস্তিষ্ক সতেজ থাকে, স্মৃতিশক্তি বাড়ে এবং মন প্রফুল্ল থাকে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত এবং সুষম ঘুম অত্যন্ত জরুরি।
ঘুমের অভাবে হওয়া রোগ
ঘুমের অভাব সরাসরি অনেক গুরুতর রোগের সাথে জড়িত:
- ডায়াবেটিস: কম ঘুম ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়।
- হৃদরোগ: ঘুমের অভাবে রক্তচাপ বাড়ে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
- কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা: খারাপ ঘুম কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়, যা ধমনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
- মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা: ডিপ্রেশন, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি।
ভালো ঘুম পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টিপস
আপনার স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে এবং ঘুমের গুণমান বাড়াতে কিছু অভ্যাস গ্রহণ করা জরুরি:
- সময় মতো ঘুমানো এবং জাগা — প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো এবং ওঠার অভ্যাস করুন।
- ঘুমোতে যাওয়ার আগে স্ক্রিন টাইম কমান — মোবাইল এবং কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো ঘুমে বাধা দেয়।
- যোগ এবং প্রাণায়াম করুন — এটি কেবল মানসিক চাপ কমায় না, ঘুমের গুণমানও উন্নত করে।
- ক্যাফিন এবং ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন — সন্ধ্যায় ক্যাফিন বা ভারী খাবার খেলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
- শান্ত এবং অন্ধকার পরিবেশ তৈরি করুন — শোবার ঘরটি শান্ত, অন্ধকার এবং ঠান্ডা রাখুন।
ঘুম এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে গভীর এবং অমূল্য সম্পর্ক রয়েছে। কম ঘুমানো যেমন ঠিক নয়, তেমনই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঘুমানোও ভালো নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭ থেকে ৯ ঘণ্টার ঘুমই একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য উপযুক্ত। তাই, আপনার দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত ঘুমের জন্য সময় বের করুন এবং নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিন।