পূজার কলস: সঠিক নিয়ম ও তাৎপর্য

পূজার কলস: সঠিক নিয়ম ও তাৎপর্য

ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে, কলসকে শুভ এবং আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ব্রত, উৎসব বা পূজা-অর্চনার শুরুতেই কলস স্থাপন করা হয়। এটিকে শুধু দেব-দেবীর প্রতীক হিসেবেই ধরা হয় না, বরং এটি সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য এবং পবিত্রতারও পরিচায়ক। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় যে, কলস স্থাপনের সময় কিছু সাধারণ কিন্তু গুরুতর ভুল করে বসেন, যা পূজার প্রভাবকে কমিয়ে দিতে পারে।

আসুন জেনে নেওয়া যাক পূজায় কলস কোথায় এবং কীভাবে রাখা উচিত, কোন দিকে এর স্থান হওয়া উচিত এবং কোন বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ রাখা জরুরি।

কলস কোন দিকে রাখা উচিত?

কলস স্থাপনের জন্য সবচেয়ে ভালো দিক হিসেবে ঈশান কোণকে ধরা হয়। এই দিকটি উত্তর এবং পূর্বের মধ্যে অবস্থিত। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বাস্তুশাস্ত্র উভয় মতেই ঈশান কোণকে দেবতাদের দিক বলা হয়েছে, যেখান থেকে ইতিবাচক শক্তি প্রবাহিত হয়।

ঈশান কোণ কেন শুভ

এই দিকটি আধ্যাত্মিকতা, জ্ঞান এবং পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কারণেই বেশিরভাগ মন্দিরেও ভগবানের মূর্তি বা ছবি এই দিকে মুখ করে রাখা হয়। যখন আপনি কলসকে এই স্থানে স্থাপন করেন, তখন আপনার পূজার স্থানে শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে।

যদি ঈশান কোণে জায়গা না থাকে, তাহলে বিকল্প কী?

উত্তর দিক: এই দিকটি ধন এবং সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

পূর্ব দিক: এই দিকটি সূর্যোদয়ের দিক হিসেবে ধরা হয় এবং এটি শুভত্বের সঙ্গে জড়িত। এখানে কলস রাখলে মানসিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

কোন দিকে কলস রাখা উচিত নয়?

কিছু দিক এমন রয়েছে যা বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে পূজা বা কলস স্থাপনের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করা হয় না।

  • দক্ষিণ দিক: এটি যমের দিক হিসেবে বিবেচিত হয়, তাই এই দিকে পূজার সামগ্রী বা কলস রাখা অশুভ বলে মনে করা হয়।
  • দক্ষিণ-পশ্চিম দিক: এটিকে 'নৈঋত্য কোণ' বলা হয় এবং এই দিকটি স্থায়িত্ব এবং ভার এর প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
  • উত্তর-পশ্চিম দিক: এটিকেও পূজার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করা হয় না কারণ এখানে অস্থিরতার শক্তি থাকে।
  • দক্ষিণ-পূর্ব দিক: এটি অগ্নি কোণ, যা তীব্র শক্তির ক্ষেত্র এবং এখানে কলস রাখলে মানসিক অশান্তি হতে পারে।

কলস স্থাপনের সম্পূর্ণ পদ্ধতি

কলস স্থাপনের আগে পূজার স্থান ভালোভাবে পরিষ্কার করা উচিত। তারপর যেখানে কলস রাখা হবে, সেখানে সামান্য মাটি বিছিয়ে তার উপর সপ্তধান্য (সাত প্রকারের শস্য) বা যব দিতে হয়। এরপর কলস স্থাপন করা হয়।

  • কলসে কী কী দিতে হয়

কলসকে গঙ্গাজল বা শুদ্ধ জল দিয়ে ভরুন। তাতে অক্ষত (চাল), সুপারি, মুদ্রা, দূর্বা (এক প্রকার ঘাস), লবঙ্গ, এলাচ এবং ফুল দিন। এই সবকিছু পঞ্চভূতের এবং পবিত্রতার প্রতীক।

  • কলসের মুখে আমের পাতা রাখুন

পাঁচ বা সাতটি আমের পাতা এমনভাবে রাখুন যাতে সেগুলির অগ্রভাগ বাইরের দিকে থাকে। এই পাতাগুলো নবগ্রহের প্রতিনিধিত্ব করে।

  • নারিকেলের স্থান ও স্থিতী

আমের পাতার উপরে লাল কাপড়ে মোড়া একটি নারকেল রাখুন। নারকেলের মুখ সেই ব্যক্তির দিকে থাকা উচিত যিনি পূজা করছেন। নারকেলটিকে সাবধানে রাখুন যাতে এটি স্থির থাকে এবং পূজার সময় নড়ে না যায়।

  • স্বস্তিক চিহ্নের তাৎপর্য

কলসের গায়ে কুমকুম দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকুন। এটিকে শুভ এবং সাফল্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।

কলস স্থাপনের পর কী করবেন

কলসে দেবতাদের, নদী এবং তীর্থের আহ্বান করা হয়। এই আহ্বান মন্ত্রের মাধ্যমে করা হয় যাতে কলস আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করতে পারে। এরপর পূজা শুরু করা হয়। পূজার শেষে কলসের জল পুরো বাড়িতে ছড়ানো হয়, যার ফলে পরিবেশ শুদ্ধ হয়।

বাকি জল এবং সামগ্রী কী করবেন

  • জল তুলসী গাছে বা বাড়ির অন্যান্য গাছে ঢেলে দিন।
  • কলসে দেওয়া শস্যগুলো পাখিদের খাওয়াতে পারেন বা মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারেন।
  • নারকেলটি প্রসাদ হিসেবে পরিবারের সদস্যদের দিন বা পূজায় ব্যবহার করুন।

কলসের ধর্মীয় তাৎপর্য

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, কলসে ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের বাস থাকে। এছাড়াও এতে সরস্বতী, লক্ষ্মী, গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, কাবেরী ইত্যাদি পবিত্র নদীরও প্রতীকী আহ্বান করা হয়।

কলসকে ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র রূপ হিসেবে মনে করা হয়। এই কারণেই এটি স্থাপন করে শক্তির আহ্বান করা হয় এবং পূজার স্থানকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে পরিপূর্ণ করা হয়।

সাধারণ মানুষের মধ্যে কলসের ঐতিহ্য

গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত, সর্বত্র কলসের স্থান সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে জড়িত। গৃহপ্রবেশ, বিবাহ, নামকরণ, নবরাত্রি, হোম, যজ্ঞ এবং দেবী পূজার প্রতিটি অনুষ্ঠানে কলসের উপস্থিতি একটি অপরিহার্য ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি অনেক স্থানে বাড়ির ছাদ বা দরজায়ও কলস রাখা হয় যাতে নেতিবাচক শক্তি প্রবেশ করতে না পারে।

এই ঐতিহ্য কেবল ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিকভাবে এবং আবেগগতভাবেও ভারতীয় পরিবারের আত্মার অংশ হয়ে উঠেছে। এই কারণেই মানুষ এখন পূজায় কলস স্থাপন আরও বেশি নিয়মনিষ্ঠভাবে করতে শুরু করেছে।

Leave a comment