মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহর হিন্দুধর্মে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এটিকে ভগবান শিবের শহর বলা হয় এবং এখানে অবস্থিত মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ সমগ্র দেশে অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার ভক্ত দর্শনের জন্য আসেন। কিন্তু এই পবিত্র শহরকে ঘিরে একটি অনন্য বিশ্বাস প্রচলিত আছে, যা রাজনৈতিক মহলেও আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে।
এই বিশ্বাস অনুসারে, কোনো মুখ্যমন্ত্রী উজ্জয়িনীতে রাত্রি যাপন করেন না। তাঁরা মহাকালেশ্বর মন্দিরে দর্শন করতে আসুন বা কোনো সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করতে, তাঁরা সন্ধ্যার আগে এখান থেকে ফিরে যান। এই প্রথা বহু বছর ধরে চলে আসছে এবং এখন একটি বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
মহাকালই উজ্জয়িনীর রাজা, অন্য কেউ থাকতে পারেন না
উজ্জয়িনীতে এই ধর্মীয় বিশ্বাস বহু শতাব্দীর পুরনো যে এই শহরের রাজা কেবল মহাকালেশ্বরই। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, যখন স্বয়ং ভগবান শিব এই নগরের শাসক, তখন কোনো সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে রাজারূপে কার্যনির্বাহ করা মুখ্যমন্ত্রীর এখানে রাতে থাকার অধিকার নেই।
এমন প্রবাদ আছে যে উজ্জয়িনীর রাজা শুধু মহাকাল। তাই অন্য কোনো রাজা যদি এই নগরীতে থাকেন, তাহলে তাঁর রাজ্য বা পদের উপর সংকট আসতে পারে। অনেক পুরনো রাজনীতিবিদদের উদাহরণও এই বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যদিও এর কোনো সরকারি বা ঐতিহাসিক প্রামাণ্য নথি নেই।
রাজনৈতিক মহলেও চর্চায় থাকে এই প্রথা
এই প্রথা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর প্রভাব রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও স্পষ্ট দেখা যায়। মুখ্যমন্ত্রী হোন বা প্রধানমন্ত্রী, উজ্জয়িনীতে আসার সময় তাঁরা যতই বড় ঘোষণা করুন, প্রকল্পের উদ্বোধন করুন, বা মহাকালেশ্বর মন্দিরে পূজা-অর্চনা করুন, কিন্তু তাঁরা রাতে থাকা থেকে বিরত থাকেন।
দেখা গেছে যে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা এখানে দিনের বেলায় আসেন, ভস্ম আরতি বা অন্য কোনো পূজা অনুষ্ঠানে অংশ নেন, কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত উজ্জয়িনী থেকে রওনা হয়ে যান। নিরাপত্তা সংস্থা এবং জেলা প্রশাসনও এই ব্যবস্থার দিকে খেয়াল রাখে এবং বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় যাতে নেতারা রাতে থাকার পরিস্থিতিতে না পড়েন।
বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে জড়িত বিশ্বাসই ভিত্তি
এই বিশ্বাস সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সময় থেকে চলে আসছে। এমনটা বলা হয় যে বিক্রমাদিত্য মহাকালেশ্বরকেই উজ্জয়িনীর শাসক ঘোষণা করেছিলেন এবং নিজে কেবল প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করতেন। তখন থেকেই এই প্রথা প্রচলিত হয়ে গেছে যে এই নগরীর রাজা কেবল ভগবান মহাকালেশ্বরই থাকবেন।
এরপর থেকে কোনো রাজা, বা বর্তমান সময়ে মুখ্যমন্ত্রী পদাধিকারী ব্যক্তি, এখানে রাতভর থাকেন না। লোককথায় এও বলা হয়েছে যে যে-ই এই প্রথা ভাঙে, তাকে নিজের পদ থেকে সরে যেতে হয় বা রাজনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
মহাকাল মন্দিরের কিছু বিশেষত্ব যা এটিকে আলাদা করে তোলে
মহাকালেশ্বর মন্দির শুধু বিশ্বাসের কারণেই নয়, বরং এর জাঁকজমক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের কারণেও বিখ্যাত। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিছু বিশেষ তথ্য:
- স্বয়ম্ভূ জ্যোতির্লিঙ্গ: এটি বিশ্বাস করা হয় যে মহাকালেশ্বর শিবলিঙ্গ স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছিল, যাকে 'স্বয়ম্ভূ' বলা হয়। এটি কোনো রাজা বা পুরোহিত দ্বারা স্থাপন করা হয়নি।
- দক্ষিণমুখী শিবলিঙ্গ: ভারতে এটিই একমাত্র জ্যোতির্লিঙ্গ যা দক্ষিণমুখী, অর্থাৎ এর মুখ দক্ষিণ দিকে। এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
- ভস্ম আরতির ঐতিহ্য: মহাকালেশ্বর মন্দিরে ভোরবেলায় করা ভস্ম আরতি সারা বিশ্বে বিখ্যাত। এতে ভগবান শিবকে চিতার ছাই দিয়ে সজ্জিত করা হয়।
- নাগচন্দ্রেশ্বর মন্দির: মন্দিরের উপরের তলায় অবস্থিত নাগচন্দ্রেশ্বর মন্দির শুধুমাত্র একদিনের জন্য নাগপঞ্চমীর দিন খোলা হয়। সারা বছরে শুধুমাত্র সেই দিনই ভক্তরা এর দর্শন করতে পারেন।
- সময়ের গণনার কেন্দ্র: প্রাচীনকালে উজ্জয়িনীকে সময়ের গণনার কেন্দ্রীয় বিন্দু হিসেবে ধরা হত। এখান থেকে সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদির গণনা করা হত।
এই বিশ্বাসের উপর কি সকলের ভরসা আছে?
যদিও এই প্রথা সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি, তবে এর প্রভাব প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপরও দেখা যায়। অনেক মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এই বিশ্বাসকে মানেন এবং যখনই উজ্জয়িনীতে আসেন, তখন শুধুমাত্র কয়েক ঘণ্টার কর্মসূচির পরেই ফিরে যান। অনেক সময় মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময়সূচিও ভস্ম আরতি বা পূজার পরেই সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাওয়ার রাখা হয়।
প্রশাসনও এই বিষয়ে খেয়াল রাখে যে কোনো মুখ্যমন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ নেতা যেন এখানে অকারণে রাত না কাটান। মহাকালের নগরীতে এই প্রথা কেবল আস্থার বিষয় নয়, বরং বহু বছর ধরে চলে আসা একটি নিয়মানুবর্তিতার মতো পালিত হয়।