সম্প্রতি, আমেরিকা ভারতের বেশ কিছু পণ্যের রপ্তানির উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এই সিদ্ধান্তের পর ভারত সরকার এবং ব্যবসায়ী মহল উভয়েই নড়েচড়ে বসেছে। কেন্দ্র সরকার এর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে গভীর আলোচনা করছে। বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল সংসদে জানিয়েছেন যে সরকার রপ্তানিকারক এবং শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিতভাবে এর পর্যালোচনা করছে এবং এর ব্যাপক প্রভাব বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমেরিকান পণ্য আমদানি বাড়ানোর প্রস্তুতি
সরকারি সূত্র অনুযায়ী, ভারত এখন আমেরিকা থেকে কিছু বিশেষ পণ্য আমদানি করার পরিকল্পনা করছে যাতে ট্রেড সারপ্লাস অর্থাৎ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমানো যায়। এর মধ্যে প্রধানত প্রাকৃতিক গ্যাস, যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং সোনা অন্তর্ভুক্ত। আগামী তিন থেকে চার বছরে এই পণ্যগুলির আমদানি ধীরে ধীরে বাড়ানো হতে পারে। এই পদক্ষেপ আমেরিকিকার সাথে বাণিজ্য ভারসাম্য তৈরির দিকে একটি পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
এফ-৩৫ নয়, এখন যৌথ নির্মাণের উপর জোর
ভারত সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা আমেরিকা থেকে এফ-৩৫ এর মতো দামি যুদ্ধবিমান কিনবে না। এর পরিবর্তে, সরকারের মনোযোগ প্রতিরক্ষা খাতে যৌথ ডিজাইন এবং নির্মাণের উপর। অর্থাৎ, ভারত এখন আমেরিকান প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির সাথে মিলিতভাবে এখানে ডিফেন্স ইকুইপমেন্ট তৈরি করতে চায়। এতে শুধু ভারতে প্রযুক্তি আসবে তাই নয়, দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্পও শক্তিশালী হবে।
এখনও কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেবে না ভারত
ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত আপাতত আমেরিকার এই শুল্ক আরোপের কোনো সরাসরি জবাব দেবে না। কিন্তু সরকার ডব্লিউটিও (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা)-তে আমেরিকার স্টিল এবং অটোমোবাইলের উপর শুল্ক বাড়ানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার সুরক্ষিত রেখেছে। অর্থাৎ, যখন প্রয়োজন হবে, ভারত নিজের অধিকার ব্যবহার করবে।
রুশ তেল এবং অস্ত্র কেনা নিয়ে আমেরিকার আপত্তি
ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ভারত কর্তৃক রাশিয়া থেকে তেল এবং অস্ত্র কেনা নিয়ে। আমেরিকা বহুবার ভারতকে রাশিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে সতর্ক করেছে। কিন্তু ভারত মনে করে যে তার কৌশলগত প্রয়োজন এবং জ্বালানি সুরক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত রাশিয়া থেকে বেশ সস্তায় অপরিশোধিত তেল কিনছে, যার ফলে দেশের বাজারে পেট্রোল-ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে।
ট্রেড সারপ্লাসের উপর আমেরিকার নজর
আইএমএফের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভারতের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার। এটি আমেরিকার মোট বাণিজ্য ঘাটতির তালিকায় ১১তম স্থানে রয়েছে। যদিও, ভিয়েতনামের সাথে এই ঘাটতি ১২১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও, ট্রাম্প সরকার ভারতকে টার্গেট করছে, কারণ আমেরিকা চায় যে ভারত তাদের বেশি পণ্য কিনুক।
ভারতীয় শিল্পের উপর শুল্কের প্রভাব
ভারতীয় রপ্তানিকারক সংগঠনগুলির বক্তব্য, আমেরিকা কর্তৃক আরোপিত নতুন শুল্ক তাদের ব্যবসার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে স্টিল, বস্ত্র এবং কিছু প্রযুক্তি নির্ভর পণ্যের চাহিদার উপর এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। অনেক কোম্পানি ইতিমধ্যেই আমেরিকাতে তাদের অর্ডার কমে যাওয়ার অভিযোগ করেছে।
দুই দেশের সম্পর্কের নতুন কষ্টিপাথর
ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক বহু দশক ধরে শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি ইঙ্গিত দেয় যে এই সম্পর্কে এখন ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে। ভারত যেখানে আত্মনির্ভরতা এবং প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্বের উপর জোর দিয়েছে, সেখানে আমেরিকা চায় যে ভারত তাদের বাজারের জন্য একটি বড় গ্রাহক হোক। এমতাবস্থায়, দেখার বিষয় হল দুই দেশ কীভাবে এই উত্তেজনা দূর করে।