অনঙ্গপাল তোমর: দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা ও হিন্দি ভাষার পৃষ্ঠপোষক

অনঙ্গপাল তোমর: দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা ও হিন্দি ভাষার পৃষ্ঠপোষক

ভারতের ইতিহাসে অনঙ্গপাল তোমর এমন এক নায়ক রূপে স্থান করে নিয়েছেন যিনি শুধুমাত্র দিল্লির ভিত্তি স্থাপন করেননি, বরং হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতিকেও শক্তিশালী করেছেন। তোমর বংশের এই মহান শাসক তাঁর শাসনকালে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সামরিক কৃতিত্ব অর্জন করেননি, সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যের দিক থেকেও অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। তাঁর শাসন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ এবং রাজস্থানের কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই নিবন্ধে অনঙ্গপাল দ্বিতীয়ের জীবন, বংশ, প্রশাসন, যুদ্ধনীতি, স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

বংশ এবং উদ্গম

অনঙ্গপাল দ্বিতীয় অর্জুনের পুত্র পরীক্ষিতের বংশধর বলে মনে করা হয়। তাঁর বংশ পরম্পরা অত্যন্ত বিস্তৃত এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ, যেখানে অনেক শক্তিশালী রাজা ও যোদ্ধাদের বর্ণনা রয়েছে। এই বংশাবলীতে পরীক্ষিত থেকে শুরু করে অনঙ্গপাল দ্বিতীয় পর্যন্ত বংশের উল্লেখ রয়েছে যা ভারতীয় ইতিহাসের পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক দিকগুলোকে যুক্ত করে। এই বংশ পরম্পরা তোমর সাম্রাজ্যের গভীরতা এবং তার স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করে।

তোমর সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান

অনঙ্গপাল দ্বিতীয়ের শাসনকালে তোমর সাম্রাজ্যের বিস্তার উত্তর ভারতের একটি বড় অংশ পর্যন্ত ছিল। এই অঞ্চলকে সেই সময় 'হরিয়ানা' বলা হত, যার অর্থ 'ঈশ্বরের বাস'। এই প্রাচীন হরিয়ানা আজকের হরিয়ানা রাজ্যের থেকে অনেক বড় ছিল। তোমর রাজধানী কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে—অনঙ্গপুর থেকে শুরু করে অবশেষে ঢিল্লিকা পুরী (আজকের দিল্লি) পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তাঁর শাসনের অধীনে পাঠানकोट, নগরকোট, অসিগড়, সৌংখ, গোয়ালিওর, ভাটিন্ডা এবং মথুরার মতো অনেক প্রধান দুর্গ ও শহর ছিল।

দিল্লি প্রতিষ্ঠা

অনঙ্গপাল দ্বিতীয়কে দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জানা যায়। তিনি ১০৫২ খ্রীষ্টাব্দে ঢিল্লিকা নামক এক নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা পরে দিল্লি নামে পরিচিত হয়। দিল্লি জাদুঘরে থাকা একটি শিলালিপিতে লেখা আছে:

'দেশোঅস্তি হরিয়ানাখ্যঃ পৃথিব্যাম্ স্বর্গসন্নিভঃ, ঢিল্লিকাখ্যা পুরী তত্র তোমারৈরস্তি নির্মিতা।'

অনঙ্গপাল সৌংখ (মথুরা) থেকে লোহার বিখ্যাত স্তম্ভ দিল্লিতে এনে স্থাপন করেন, যা আজও কুতুব কমপ্লেক্সে দেখা যায়। এই স্তম্ভে অঙ্কিত শিলালিপি থেকে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায় যে অনঙ্গপাল দিল্লিতে এই স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন।

স্থাপত্য অবদান: লাল কোট এবং অন্যান্য নির্মাণ

অনঙ্গপাল দ্বিতীয় দিল্লিতে লাল কোট নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে কিলা রায় পিথোরা নামে পরিচিত হয়। এটি ছিল দিল্লির প্রথম 'লাল কেল্লা', যার দেওয়াল ৬০ ফুট উঁচু এবং ৩০ ফুট মোটা ছিল। এর পরিধি ছিল প্রায় ২ মাইল। তিনি এই দুর্গের কেন্দ্রে লৌহ স্তম্ভ স্থাপন করে এটিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি অসিগড় (হাंसी), তহানগড় (কারাউলি), পাটন (রাজস্থান), বল্লভগড়, সৌংখ, বাদলগড় এবং মহেন্দ্রগড়েও দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। হ্যাঁসির অসিগড় দুর্গে তলোয়ার নির্মাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল, যেখান থেকে তলোয়ার আরব দেশগুলোতেও রপ্তানি করা হত।

ধার্মিক বিশ্বাস এবং যোগমায়া মন্দির

অনঙ্গপাল দ্বিতীয়ের ধার্মিক বিশ্বাসও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি মেহরাউলিতে অবস্থিত যোগমায়া মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা তাঁর কুলদেবীকে উৎসর্গিত ছিল। এই মন্দির ২৭টি মন্দিরের মধ্যে একটি ছিল যা মুসলিম আক্রমণকারীরা ধ্বংস করেছিল, কিন্তু এটি আজও জীবিত ধার্মিক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর কাছাকাছি অবস্থিত অনঙ্গতাল বাওলিও তাঁর দ্বারা নির্মিত, যা জল সংরক্ষণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সূর্যকুণ্ড এবং সাংস্কৃতিক মেলার সূচনা

তাঁর পুত্র সুরজপাল দ্বারা নির্মিত সূর্যকুণ্ড আজও একটি প্রধান সাংস্কৃতিক স্থান, যেখানে প্রতি বছর আন্তর্জাতিক শিল্প মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই স্থান স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির প্রতীক, এবং তোমর বংশের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে।

সামরিক শক্তি এবং যুদ্ধনীতি

অনঙ্গপাল দ্বিতীয় ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা এবং দূরদর্শী रणनीतिकार। শ্রীধরের 'পার্শ্বনাথ চরিত' অনুসারে, তিনি হিমাচল প্রদেশে ইব্রাহিম গজনভি এবং কাশ্মীরের উৎপল বংশের রাজা কলশদেবকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর সামরিক ক্ষমতা এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা প্রায় ১৫০টি ছোট রাজ্যের শাসকরা তাঁকে সর্বোচ্চ মনে করতেন। তিনি তাঁর শত্রুদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যেমন একটি শিলালিপিতে বর্ণিত আছে: 'অসিভর তোডিয় রিউ কवालু, রণাनाহু सिद्धू अनंगवालु।'

হিন্দি ভাষার সংরক্ষণ

অনঙ্গপাল দ্বিতীয়কে হিন্দি ভাষার সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির श्रेयও দেওয়া হয়। তিনি সংস্কৃত এবং হরিয়ানভিতে মুদ্রা তৈরি করিয়েছিলেন যেগুলিতে 'শ্রী অঙ্গপাল' এবং 'শ্রী অনঙ্গপাল' অঙ্কিত ছিল। ইতিহাসবিদ হরিহর নিবাস দ্বিবেদীর মতে, মধ্যকালীন হিন্দির প্রকৃত বিকাশ তোমর বংশের শাসনকালে হয়েছিল এবং অনঙ্গপাল দ্বিতীয় ছিলেন এর প্রধান প্রবর্তক।

দিল্লির নামকরণ: ঢিল্লিকা থেকে দিল্লি পর্যন্ত

'দিল্লি' শব্দটি 'ঢিল্লিকা' থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন শিলালিপি এবং সাহিত্যিক গ্রন্থ যেমন 'পাসনাহা চারু' এবং 'পৃথ্বীরাজ রাসো'-তে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এও कहा হয় যে যখন অনঙ্গপাল কিল্লি (কীল) স্থাপন করেছিলেন তখন ব্যাস বলেছিলেন, "ঢিল্লি সईव" — এবং तब থেকে এই স্থানের नाम 'ঢিল্লি' হয়ে যায়।

অনঙ্গপাল দ্বিতীয়ের উত্তরাধিকার

ভারত সরকার কর্তৃক অনঙ্গপাল দ্বিতীয়ের স্মৃতিতে 'মহারাজা অনঙ্গপাল দ্বিতীয় স্মারক সমিতি' স্থাপন করা হয়েছে। এর অধীনে দিল্লি বিমানবন্দরে তাঁর মূর্তি, একটি সংগ্রহশালা এবং লাল কোটের খনন ও সংরক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে। এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র তাঁর ঐতিহাসিক পরিচয়কে পুনরুজ্জীবিত করে না, বরং আধুনিক প্রজন্মকে ভারতের প্রাচীন গৌরব সম্পর্কে পরিচিতও করায়।

অনঙ্গপাল দ্বিতীয় শুধুমাত্র একজন যোদ্ধা বা শাসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভারতের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং স্থাপত্য ঐতিহ্যের মহান নির্মাতা। তিনি দিল্লিকে একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক রাজধানীতে রূপান্তরিত করেছিলেন এবং হিন্দি ভাষাকে শক্তিশালী করার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর অবদান আজও দিল্লির রাস্তায়, দুর্গে, মন্দিরে এবং বাওলিতে জীবন্ত। এই ধরণের শাসকের স্মৃতি ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া ভারতীয় ইতিহাসের ঋণ পরিশোধ করার মতোই।

Leave a comment