চার্লস রিখটার: ভূমিকম্প বিজ্ঞানের পথিকৃৎ

চার্লস রিখটার: ভূমিকম্প বিজ্ঞানের পথিকৃৎ

চার্লস ফ্রান্সিস রিখটার—এমন একটি নাম যা ভূমিকম্প বিজ্ঞানের জগতে বিপ্লব আনার জন্য পরিচিত। যদিও সাধারণ মানুষ তাঁকে শুধুমাত্র 'রিখটার স্কেল'-এর সূত্রে জানে, কিন্তু তাঁর অবদান ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপের চেয়েও অনেক বেশি গভীর এবং ব্যাপক। তিনি শুধু বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামকে নতুন দিশা দেননি, সমাজকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস এবং মূল্যায়ন কীভাবে করা যেতে পারে সে বিষয়েও বুঝতে সাহায্য করেছেন।

প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা: ছোট শহর থেকে বিজ্ঞানের উচ্চতায়

চার্লস ফ্রান্সিস রিখটার ২৬ এপ্রিল, ১৯০০ সালে ওহাইওর একটি ছোট গ্রাম ওভারপেকের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক জীবন জটিল ছিল; শৈশবেই তাঁর বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়, যার পরে তিনি তাঁর মা এবং নানার সাথে লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে আসেন। এখান থেকেই তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন এবং লস অ্যাঞ্জেলেস হাই স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্ট্যানফোর্ডে পড়ার সময় তাঁর ভূমিকম্প বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ জন্মায়। পরবর্তীতে তিনি পাসাডেনাতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (ক্যালটেক)-এ বেনো গুটেনবার্গের অধীনে কাজ করেন, যা তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবনের দিকনির্দেশক পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হয়।

ভূমিকম্প বিজ্ঞানের দিকে পদক্ষেপ: পরিমাপের নতুন যুগ

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য কোনো সঠিক বৈজ্ঞানিক মাপকাঠি ছিল না। সেই সময় শুধুমাত্র মারক্যালি স্কেল প্রচলিত ছিল, যা ভূমিকম্পের তীব্রতাকে মানুষের অভিজ্ঞতা এবং বিল্ডিংয়ের ক্ষতির ওপর ভিত্তি করে পরিমাপ করত। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল এটি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিনিষ্ঠ ছিল। চার্লস রিখটার এবং বেনো গুটেনবার্গ একসঙ্গে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেন এবং ১৯৩৫ সালে রিখটার স্কেল তৈরি করেন। এই স্কেলের বিশেষত্ব ছিল এটি ভূমিকম্পের তীব্রতাকে সিসমোগ্রাফের সাহায্যে নথিভুক্ত করত এবং এটি একটি লোগারিদমিক গণনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। এর অর্থ হল, ৬.০ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ৫.০ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে দশ গুণ বেশি শক্তি নির্গত করে।

রিখটার স্কেল একটি নিখুঁত পরিমাপ ব্যবস্থা ছিল এবং এটি ভূমিকম্পের কেন্দ্র ও পৃথিবীর পৃষ্ঠের ওপর এর প্রভাব উভয়কেই নজরে রাখত। এটি ভূমিকম্প পরিমাপকে একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেয় এবং সারা বিশ্বে একটি মান প্রতিষ্ঠা করে।

গুটেনবার্গের অবদান এবং নামের বিতর্ক

যদিও রিখটার স্কেল মূলত রিখটার এবং গুটেনবার্গের অংশীদারিত্বের ফল ছিল, কিন্তু শুরুতে গুটেনবার্গের নাম এই স্কেলে যোগ করা হয়নি। এর কারণ ছিল গুটেনবার্গ জনসমক্ষে সাক্ষাৎকার এবং মিডিয়াতে আসা এড়িয়ে চলতেন। যদিও পরে রিখটার নিজে স্বীকার করেছিলেন যে গুটেনবার্গ ছাড়া এই কাজ সম্ভব ছিল না এবং তিনি তাঁর সহযোগীকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিও জানিয়েছিলেন।

গবেষণা এবং শিক্ষাদান: জ্ঞান বিতরণে অঙ্গীকারবদ্ধ

রিখটার শুধু গবেষক ছিলেন না, একজন নিবেদিত শিক্ষকও ছিলেন। তিনি ক্যালটেকে দীর্ঘ সময় ধরে অধ্যাপনা করেছেন এবং ১৯৫৮ সালে "এলিমেন্টারি সিসমোলজি" নামক একটি বই প্রকাশ করেন, যা আজও ভূমিকম্প বিজ্ঞানের ছাত্র এবং গবেষকদের জন্য একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি জাপানে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে কাজ করেছেন এবং সেখানকার ভূমিকম্প বিজ্ঞানীদের সাথে সহযোগিতা করেছেন। তিনি বিল্ডিং কোডে উন্নতির জন্য সক্রিয়ভাবে প্রচার চালিয়েছিলেন, যার ফলে অনেক পৌরসভা তাদের নির্মাণ কাঠামোতে ভূমিকম্প-নিরোধক পরিবর্তন আনে।

রিখটার স্কেলের বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাব

রিখটার স্কেল শুধুমাত্র ভূমিকম্প মাপার পদ্ধতিকেই পরিবর্তন করেনি, বরং এর সাহায্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নীতি এবং কৌশলগুলোতেও উন্নতি হয়েছে। এই স্কেল বিজ্ঞানীদের ভূমিকম্পের তীব্রতা, প্রভাবিত অঞ্চল এবং সম্ভাব্য ক্ষতির সঠিক অনুমান করার ক্ষমতা দিয়েছে। এর লোগারিদমিক গঠন এটিকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উপযোগী করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি ভূমিকম্পের তীব্রতা ৭.০ হয় এবং অন্যটির ৫.০, তাহলে সেটি শুধুমাত্র দুই অঙ্কের পার্থক্য নয়, বরং শক্তিতে একশো গুণ বেশি পার্থক্য রয়েছে। যদিও পরবর্তীতে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেলের মতো আরও অনেক পরিমাপ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, কিন্তু রিখটার স্কেল আজও সাধারণ ভাষা এবং মিডিয়াতে ভূমিকম্পের তীব্রতা জানানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।

ব্যক্তিগত জীবন: বিজ্ঞান থেকে দূরে একজন মানুষ

চার্লস রিখটারের জীবন শুধু বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একজন ঘোষিত ন্যাচারিস্ট ছিলেন—অর্থাৎ তিনি প্রাকৃতিক জীবনযাপন, বিশেষ করে নগ্নতাকে একটি সহজ এবং স্বাভাবিক জীবন শৈলী হিসেবে মনে করতেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী অনেক ন্যাচারিস্ট রিসোর্টে ভ্রমণ করেছেন। ১৯৭২ সালে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়, যার পরে তিনি एकांतप्रिय জীবন যাপন করেন। ১৯৮৫ সালে ৮৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁকে ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউ কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।

উত্তরাধিকার: বিজ্ঞানের ভূমিতে অমলিন ছাপ

চার্লস ফ্রান্সিস রিখটারের সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার হল তিনি এমন একটি সিস্টেম দিয়েছেন যা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়ক। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বোঝা এবং তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর জীবন প্রমাণ করে যে বিজ্ঞান শুধু পরীক্ষাগারেই নয়, সমাজের নিরাপত্তা ও উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে নীতি, শহুরে উন্নয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করা যায়।

চার্লস ফ্রান্সিস রিখটার একজন বিজ্ঞানীই ছিলেন না, একজন স্বপ্নদ্রষ্টাও ছিলেন। তিনি ভূমিকম্প বিজ্ঞানকে শুধু সরঞ্জাম এবং গণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং একে জীবন, নিরাপত্তা এবং সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করে দেখেছিলেন। তাঁর তৈরি করা রিখটার স্কেল বিজ্ঞানকে শুধু নির্ভুলতাই দেয়নি, সমাজকে দিয়েছে বোঝাপড়া ও সচেতনতা।

Leave a comment