ডিপফেক নিয়ন্ত্রণে ডেনমার্কের নতুন আইন: ডিজিটাল পরিচয় সুরক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ

ডিপফেক নিয়ন্ত্রণে ডেনমার্কের নতুন আইন: ডিজিটাল পরিচয় সুরক্ষায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ

ডেনমার্ক ডিপফেক নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন আনতে চলেছে, যা কোনো ব্যক্তির ডিজিটাল পরিচয়, যেমন মুখ এবং কণ্ঠস্বরকে আইনি সুরক্ষা দেবে।

Deepfake Video: ডিপফেক প্রযুক্তি একদিকে যেমন বিনোদনের জগতে নতুন সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে, তেমনই এর অপব্যবহার ব্যক্তিগত পরিচয়, গোপনীয়তা এবং বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাকে গুরুতর সংকটে ফেলেছে। এখন এই ক্রমবর্ধমান বিপদ ঠেকাতে সরকারগুলো কঠোর হতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ডেনমার্ক, যা ইউরোপে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পরিচয় সুরক্ষার জন্য আইনি পরিবর্তনের দিকে বড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

ডিপফেক কী?

ডিপফেক প্রযুক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির মুখ বা কণ্ঠস্বরকে এত নিখুঁতভাবে অন্য কোনো ভিডিও, অডিও বা ছবিতে যুক্ত করা হয় যে আসল এবং নকলের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো ফিল্মের দৃশ্যে অভিনেতার চেহারা বদলে দেওয়া হোক বা কোনো রাজনীতিবিদকে দিয়ে এমন কথা 'বলানো' যা তিনি কখনো বলেননি — ডিপফেক এটাই করে। কিছু ক্ষেত্রে এটি কেবল মজা বা বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, এর মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর খবর, আর্থিক জালিয়াতি এবং সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।

ডেনমার্কের আইনি প্রস্তুতি

ডেনমার্ক সরকার ডিজিটাল যুগের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তাদের কপিরাইট আইনে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। সরকারের প্রস্তাব হলো, ব্যক্তির ছবি, কণ্ঠস্বর এবং অন্যান্য ডিজিটাল পরিচয়কে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই উদ্যোগ ডিজিটাল গোপনীয়তা সুরক্ষায় ইউরোপের মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই আইনের অধীনে যদি কোনো ব্যক্তির ছবি বা কণ্ঠস্বর অপব্যবহার করা হয়, তাহলে তার সেই ভিডিও বা কনটেন্ট সরানোর অধিকার থাকবে। শুধু তাই নয়, তিনি ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারবেন — এবং এই অধিকার শিল্পীর মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও বহাল থাকবে।

সংসদে পেশ হবে বিল

ডেনমার্ক সরকার এই আইনটি ২০২৫ সালের শরৎকালে (Autumn) সংসদে পেশ করার পরিকল্পনা করেছে। প্রাথমিকভাবে এটি সব প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থন পাচ্ছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে ডিজিটাল অধিকারের সুরক্ষা এখন জাতীয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

কেন জরুরি এই আইন?

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ডিপফেক সম্পর্কিত ঘটনাগুলো গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেন এবং আমেরিকার শীর্ষ নেতাদের নকল ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি Arup একটি এআই ভিত্তিক ভিডিও কলের মাধ্যমে $২৫ মিলিয়ন ডলারের প্রতারণার শিকার হয়েছে। Ferrari-র CEO-এর নকল কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে জালিয়াতির চেষ্টা করা হয়েছে। একজন সাংবাদিক তার কণ্ঠস্বরের ডিপফেক কপি দিয়ে একটি ব্যাংকের ভয়েস অথেন্টিকেশন সিস্টেম ভেঙে ফেলেছেন।

AI নিরাপত্তা সংস্থা Resemble.ai-এর মতে, ২০২৫ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ৪৮৭টি ডিপফেক হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হামলাগুলোতে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে।

বৈশ্বিক স্তরে কী হচ্ছে?

আমেরিকা Take It Down Act কার্যকর করেছে, যার অধীনে ক্ষতিকর ডিপফেক কনটেন্ট ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক এবং লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ফেডারেল শাস্তির বিধান রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের Digital Services Act (DSA) ২০২৪ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে, যা অনলাইন ভুল তথ্য এবং অবৈধ কনটেন্ট বন্ধ করে। ব্রিটেনে Online Safety Act ২০২৫ থেকে চালু হয়েছে, যা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়িত্ব বাড়িয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর উপর কড়া নজর

ডেনমার্কের প্রস্তাবিত আইনে এও বলা হয়েছে যে, যদি Meta (Facebook), X (পূর্বের Twitter) এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অবৈধ ডিপফেক কনটেন্ট পাওয়া যায় এবং তারা তা সরাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের উপর ভারী জরিমানা করা হতে পারে। এই পদক্ষেপ শুধু কনটেন্ট সরানোর দায়িত্বই নির্ধারণ করবে না, বরং প্ল্যাটফর্মগুলোকে তাদের অ্যালগরিদম এবং মডারেশন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করতে উৎসাহিত করবে।

Leave a comment