নাসিরুদ্দিন মহম্মদ হুমায়ুন: মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট ও তাঁর অমর কীর্তি

নাসিরুদ্দিন মহম্মদ হুমায়ুন: মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট ও তাঁর অমর কীর্তি

নাসিরুদ্দিন মহম্মদ হুমায়ুন (১৫০৮-১৫৫৬) মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট ছিলেন। বাবর-এর মৃত্যুর পর ২৯ ডিসেম্বর ১৫৩০ সালে তিনি দিল্লির সিংহাসনে বসে তাঁর পিতার উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বাবর তাঁর জীবদ্দশায় রাজ্যকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দিয়েছিলেন যাতে ভাইদের মধ্যে সংঘাত না হয়। কিন্তু হুমায়ুনের ভাই – কামরান, আসকারী এবং হিন্দাল – সময় এলে তাঁর সহযোগী প্রমাণিত হননি। সেই সময়ে সাম্রাজ্যের যখন ঐক্যের প্রয়োজন ছিল, তখন তাঁরা ব্যক্তিগত महत्वाকাঙ্ক্ষায় জড়িয়ে পড়েন।

শের শাহ সুরির সাথে সংঘর্ষ এবং নির্বাসন

হুমায়ুনের শাসনকাল শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ ছিল। আফগান শাসক শের শাহ সুরি ১৫৩৯ সালের চৌসা এবং ১৫৪০ সালের কনৌজ (বিলগ্রাম) যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করেন। ফলস্বরূপ হুমায়ুনকে ভারত ছাড়তে হয়। তিনি সিন্ধু, অমরকোট এবং কাবুল-এর মতো স্থানে নির্বাসনের সময় কাটান। অমরকোটে ১৫৪২ সালে তাঁর পুত্র জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর-এর জন্ম হয়। পরে তিনি ইরানের শাহ তাহমাস্পের কাছে আশ্রয় নিতে যান, যেখান থেকে তিনি কাবুল ও কান্দাহার অধিকার করতে সহায়তা পান।

সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধার

প্রায় পনেরো বছর পর, ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন পুনরায় দিল্লি অধিকার করেন। শের শাহ সুরির মৃত্যুর পর তাঁর বংশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হুমায়ুন লাহোর, দিল্লি এবং আগ্রা দখল করেন। যদিও তাঁর পুনর্নির্মিত শাসনকাল খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবে তিনি আকবরের জন্য সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করে দেন।

অকাল মৃত্যু এবং ক্ষমতার হস্তান্তর

জানুয়ারি ১৫৫৬ সালে দিল্লির দীনপানাহ ভবনের সিঁড়ি থেকে পড়ে হুমায়ুনের মৃত্যু হয়। সেই সময় তাঁর পুত্র আকবর পাঞ্জাবের কালানৌরে ছিলেন। সেখানেই তাঁর রাজ্যাভিষেক করা হয়। হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যু সত্ত্বেও মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব টিকে থাকে, এবং আকবর পরবর্তীতে এর বিস্তার ঘটান।

হুমায়ুনের সমাধি – স্থাপত্যের অনন্য উদাহরণ

হুমায়ুনের মৃত্যুর নয় বছর পর তাঁর বিধবা হামিদা বানু বেগম ১৫৬২ সালে তাঁর জন্য একটি भव्य সমাধির নির্মাণের আদেশ দেন। ফার্সি স্থপতি মিরাক মির্জা ঘিয়াস দ্বারা ডিজাইন করা এই স্মারকটির নির্মাণ ১৫৭১ সালে সম্পন্ন হয়েছিল। এটি ভারতে মুঘল স্থাপত্যের প্রথম বড় নমুনা।

  • চারবাগ শৈলী: সমাধিটি চারটি অংশে বিভক্ত বাগান দ্বারা ঘেরা, যা ইসলামী ধারণা ‘জান্নাতের চার নদীর বাগান’-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি।
  • লাল বেলেপাথর এবং সাদা মার্বেলের সংমিশ্রণ: এটি ছিল প্রথমবার যখন এত বিপুল পরিমাণে লাল বেলেপাথর ব্যবহার করা হয়েছিল।
  • গম্বুজ এবং জাল: ফার্সি প্রভাব যুক্ত ডাবল-ডোম, পিট্রা ডিউরা পচ্চিকারি এবং মার্বেলের জাল এই সমাধিটির বিশেষ পরিচিতি।

সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য

হুমায়ুনের সমাধি কেবল স্থাপত্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি সেই সময়ের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিকেও প্রতিফলিত করে। মুঘল দরবারের চরিত্র মধ্য এশিয়া থেকে ফার্সি শৈলীর দিকে পরিবর্তিত হচ্ছিল। এই সমাধির নির্মাণ ভবিষ্যতে তাজমহলের মতো স্মৃতিস্তম্ভগুলির জন্য পথ প্রশস্ত করেছিল।

সংস্কার ও সংরক্ষণ

ব্রিটিশ শাসনামলে এবং স্বাধীনতার পরে এই চত্বরটি বহুবার অবহেলার শিকার হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চারবাগের स्वरूपকে ইংরেজি বাগান শৈলীতে পরিবর্তন করা হয়েছিল। দেশভাগের (১৯৪৭) সময় এই অঞ্চলটি শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছিল, যার ফলে প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। পরে আগা খান ট্রাস্ট এবং ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (ASI) এটির পুনর্নির্মাণ করে। ২০০৩ সালের সংস্কারের পর বাগানগুলির জল-প্রণালী পুনরায় সক্রিয় হয় এবং স্মৃতিস্তম্ভটি তার পুরনো সৌন্দর্য ফিরে পায়।

ঐতিহ্য এবং আজকের প্রেক্ষাপট

আজ হুমায়ুনের সমাধি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান। এটি কেবল পর্যটকদের আকর্ষণ করে না, বরং ভারতের ইতিহাস এবং স্থাপত্যের গভীর ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রমাণও। এই স্মৃতিস্তম্ভটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করার পরেও একজন শাসক তাঁর সাংস্কৃতিক এবং স্থাপত্য ঐতিহ্যের দ্বারা ইতিহাসে অমর হতে পারেন। হুমায়ুনের জীবন সংগ্রামে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু তাঁর দূরদর্শিতা এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতকে এমন একটি ঐতিহ্য দিয়েছে, যা আজও বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়। যদি আপনি দিল্লি যান, তবে এই বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানটি অবশ্যই দেখুন এবং ভারতীয় ইতিহাসের এই অমূল্য সূত্রটিকে কাছ থেকে অনুভব করুন।

হুমায়ুন, বাবরের পুত্র এবং মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট, ১৫৩০ সালে সিংহাসনে বসেন। শের শাহ সুরি-র কাছে পরাজিত হয়ে নির্বাসনে যান এবং ইরানের সহায়তায় ১৫৫৫ সালে পুনরায় দিল্লি দখল করেন। ১৫৫৬ সালে সিঁড়ি থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। হুমায়ুনের সমাধি দিল্লিতে অবস্থিত, যা হামিদা বানু বেগম নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি মুঘল স্থাপত্যের প্রথম বড় উদাহরণ এবং চারবাগ শৈলীর উপর ভিত্তি করে তৈরি। ১৯৯৩ সালে এটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করা হয়।

Leave a comment