ভারত ৭,৩৫০ কোটির রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট প্রকল্পে চীনের আধিপত্য ভাঙতে প্রস্তুত

ভারত ৭,৩৫০ কোটির রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট প্রকল্পে চীনের আধিপত্য ভাঙতে প্রস্তুত

ভারত সরকার ৭,৩৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে পাঁচটি রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট (REPM) প্ল্যান্ট স্থাপন করতে চলেছে, যাতে চীনের উপর নির্ভরতা কমানো যায় এবং দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই প্রকল্পটি সাত বছর ধরে চলবে, যার ফলে ভারত ৬,০০০ টন বার্ষিক ক্ষমতাসম্পন্ন একটি দেশীয় উৎপাদন ইকোসিস্টেম তৈরি করবে, যা অটো, ইলেকট্রনিক্স এবং প্রতিরক্ষা সেক্টরগুলিকে শক্তিশালী করবে।

রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট: ভারত সরকার চীনের একাধিপত্য ভাঙতে রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটের দেশীয় উৎপাদনের জন্য একটি বড় পরিকল্পনা তৈরি করেছে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারী শিল্প মন্ত্রক ৭,৩৫০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অধীনে পাঁচটি ইন্টিগ্রেটেড REPM উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করবে। প্রতিটি ইউনিটের ক্ষমতা ১,২০০ টন পর্যন্ত হবে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে ভারতে ৬,০০০ টন বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি উৎপাদন নেটওয়ার্ক তৈরি করা। এই পদক্ষেপ চীনের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর নেওয়া হয়েছে, যা ভারতের অটো এবং ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে প্রভাবিত করেছিল।

চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার প্রস্তুতি

বর্তমানে গোটা বিশ্বে রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটের সরবরাহে চীনের আধিপত্য রয়েছে। চীন সম্প্রতি এই ম্যাগনেটগুলির রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, যার ফলে ভারতের অটোমোবাইল এবং ইলেকট্রনিক্স সেক্টর ধাক্কা খেয়েছিল। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারত এখন নিজস্ব স্বাধীন সাপ্লাই চেইন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকারের এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সরকারের লক্ষ্য হলো সিন্টারড রেয়ার আর্থ পারমানেন্ট ম্যাগনেটের উৎপাদন বাড়ানো, যাতে আমদানির উপর নির্ভরতা কমানো যায়। এই প্রকল্পের অধীনে দেশে একটি সম্পূর্ণ দেশীয় উৎপাদন ইকোসিস্টেম তৈরি করা হবে, যার বার্ষিক ক্ষমতা ৬,০০০ টন পর্যন্ত হবে।

সাত বছরে তৈরি হবে সম্পূর্ণ উৎপাদন নেটওয়ার্ক

সরকারী নথি অনুযায়ী, এই প্রকল্পটি সাত বছর ধরে চলবে। এর উদ্দেশ্য হলো এনডিপিআর (নিওডিমিয়াম-প্র‍্যাসিওডিমিয়াম) অক্সাইডকে সিন্টারড এনডিএফইবি (নিওডিমিয়াম-আয়রন-বোরন) ম্যাগনেটে রূপান্তর করার একটি দেশীয় সরবরাহ চেইন তৈরি করা।

এই ম্যাগনেটগুলি অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স, প্রতিরক্ষা এবং বায়ু শক্তি (উইন্ড এনার্জি) এর মতো ক্ষেত্রগুলির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। REPM উৎপাদনে মাইনিং, প্রসেসিং, এক্সট্রাকশন, রিফাইনিং এবং ধাতু থেকে ম্যাগনেট তৈরির প্রক্রিয়া সহ অনেক ধাপ জড়িত। বর্তমানে ভারতের কাছে এই চূড়ান্ত ধাপগুলির জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে।

পাঁচটি বড় প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে, পাওয়া যাবে সরকারি সাহায্য

সরকার পাঁচটি ইন্টিগ্রেটেড REPM উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। প্রতিটি ইউনিটের ক্ষমতা প্রতি বছর ১,২০০ টন হবে। কোম্পানিগুলি সর্বনিম্ন ৬০০ টন এবং সর্বোচ্চ ১,২০০ টন প্রতি বছর ক্ষমতার জন্য আবেদন করতে পারবে।

এই কোম্পানিগুলিকে দুই ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। প্রথমত, ম্যাগনেটের বিক্রির উপর সেলস বেজড ইনসেনটিভ এবং দ্বিতীয়ত, ইউনিট স্থাপনের জন্য ক্যাপিটাল সাবসিডি। সরকারের অনুমান, বর্তমানে ভারতের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪,০১০ টন, যা ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে ৮,২২০ টন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

দুই বছরে উৎপাদন শুরু হবে

এই প্রকল্পের অধীনে দুই বছরের মধ্যে প্ল্যান্ট স্থাপন এবং উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১ এপ্রিল ২০২৫ এর পর করা যোগ্য বিনিয়োগের উপর কোম্পানিগুলিকে ১৫ শতাংশ ক্যাপিটাল সাবসিডি দেওয়া হবে।

সরকার আশা করছে যে তৃতীয় থেকে সপ্তম বছরের মধ্যে উৎপাদন বাড়িয়ে বার্ষিক ৬,০০০ টন ক্ষমতায় পৌঁছানো হবে। প্ল্যান্ট স্থাপনের খরচ বেশি হবে কারণ মেশিনারি এবং সরঞ্জাম চীন ছাড়া অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাড়িয়েছে উদ্বেগ

ভারতে রেয়ার আর্থ ম্যাগনেটের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল, উইন্ড টার্বাইন, মোবাইল, কম্পিউটার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল মোটর-এর মতো ক্ষেত্রগুলিতে এদের প্রয়োজন ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২২ সালে যেখানে দেশের মোট চাহিদা প্রায় ১,৫০০ টন ছিল, সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৮,০০০ টনের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আইআরইএল (ইন্ডিয়ান রেয়ার আর্থস লিমিটেড)-এর তথ্য অনুযায়ী, ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। ২০২২ সালে যেখানে ৪০০ টন চাহিদা ছিল, তা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩,২৫০ টন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। উইন্ড টার্বাইন সেক্টরেও এই চাহিদা ৪৩০ টন থেকে বেড়ে ১,৮০০ টন পর্যন্ত পৌঁছানোর আশা করা হচ্ছে।

স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হবে নির্বাচন

ভারী শিল্প মন্ত্রক এই প্রকল্পের জন্য গ্লোবাল টেন্ডার জারি করবে। এর অধীনে পাঁচটি REPM ইউনিটের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় "টু-এনভেলপ সিস্টেম" অনুসরণ করা হবে, যেখানে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক উভয় বিড অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শুধুমাত্র প্রযুক্তিগতভাবে যোগ্য কোম্পানিগুলির আর্থিক বিড খোলা হবে।

কোম্পানিগুলিকে প্রতি কিলোগ্রাম বিক্রয় ইনসেনটিভের প্রস্তাব দিতে হবে, যার সর্বোচ্চ সীমা ২,১৫০ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম নির্ধারণ করা হয়েছে। যে পাঁচটি কোম্পানির ইনসেনটিভের পরিমাণ সবচেয়ে কম হবে, তাদের L1 থেকে L5 ক্রমে নির্বাচন করা হবে এবং তারাই এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসাবে বিবেচিত হবে।

সরবরাহ শৃঙ্খল এবং কাঁচামালের ব্যবস্থা

ভারতে বর্তমানে রেয়ার আর্থ কাঁচামালের দেশীয় সরবরাহ সীমিত। আইআরইএল বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ টন এনডিপিআর অক্সাইড উৎপাদন করে, যা প্রায় ১,৫০০ টন ম্যাগনেট উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট।

এই প্রকল্পের অধীনে, আইআরইএল L1, L2 এবং L3 কোম্পানিগুলিকে কিছু পরিমাণে কাঁচামাল সরবরাহ করবে। অন্যদিকে, L4 এবং L5 কোম্পানিগুলিকে তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাঁচামাল নিজেদেরই সংগ্রহ করতে হবে।

সরকার এই পুরো প্রকল্পের তদারকির জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে, যার সভাপতিত্ব করবেন ভারী শিল্প মন্ত্রকের সচিব। এই কমিটি সময়সীমা পালন, অগ্রগতির পর্যালোচনা এবং আগত চ্যালেঞ্জগুলির সমাধানের উপর নজর রাখবে।

ভারতের এই উদ্যোগ কেবল দেশকে চীনের নির্ভরতা থেকে মুক্ত করবে না, বরং আগামী বছরগুলিতে রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট উৎপাদনের একটি নতুন বৈশ্বিক কেন্দ্রও তৈরি করতে পারে।

Leave a comment