ইরান, এমন একটি দেশ যা শুধুমাত্র পশ্চিম এশিয়াতেই নয়, বিশ্ব নিরাপত্তা পরিকাঠামোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দীর্ঘকাল ধরে পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত এই দেশটি এখন অস্ত্র প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। যেখানে একদিকে বিশ্ব শক্তিগুলি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন, সেখানে ইরানের কিছু অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি সামনে এসেছে, যা কেবল আঞ্চলিক সংঘাতকে আরও উস্কে দিতে পারে তাই নয়, বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের সমীকরণও পুরোপুরি বদলে দিতে পারে।
১. শাহেদ-১৩৬ ড্রোন: কম খরচ, বেশি ধ্বংস
ইরান দ্বারা নির্মিত শাহেদ-১৩৬ আত্মঘাতী ড্রোন বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা সংস্থাগুলির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ড্রোনটিকে 'লোইটারিং মিউনিশন' অর্থাৎ ঘুরে বেড়ানো গোলাবারুদ ব্যবস্থা বলা হয়, যা টার্গেটের ওপর ঘোরাফেরা করে এবং তারপর নির্ভুলভাবে হামলা করে।
বৈশিষ্ট্য:
- রেঞ্জ: প্রায় ২০০০ কিমি
- বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে সরাসরি লক্ষ্যে আঘাত করে
- রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার উন্নত ক্ষমতা
- সম্মিলিত আক্রমণে ব্যাপক বিধ্বংসী প্রভাব
এই ড্রোন বিশেষভাবে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন এটিকে একসঙ্গে बड़ी সংখ্যায় পাঠানো হয় — যার ফলে শত্রুর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ওভারলোড হয়ে যায়।
২. ব্যালিস্টিক মিসাইল: ফতেহ-১১০ এবং জুলফিকার
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির মেরুদণ্ড হল — ফতেহ-১১০ এবং জুলফিকার। এই শর্ট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলি শত্রুর ঘাঁটিগুলিকে নির্ভুলভাবে নিশানা করে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে।
প্রধান প্রযুক্তিগত শক্তি:
- ফতেহ-১১০-এর মারক ক্ষমতা: ~৩০০ কিমি
- জুলফিকরের মারক ক্ষমতা: ~৭০০ কিমি
- GPS ভিত্তিক গাইডেন্স
- মোবাইল লঞ্চ প্ল্যাটফর্ম, যে কারণে ট্র্যাক করা কঠিন
এই মিসাইলগুলি কৌশলগত ঘাঁটিগুলিতে দ্রুত এবং আকস্মিকভাবে আঘাত করতে পারে, যার ফলে শত্রুকে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় পাওয়া যায় না।
৩. আন্ডারগ্রাউন্ড মিসাইল বেস: ‘মিসাইল সিটি’-র রণনীতি
ইরান এমন কিছু ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ এবং বাঙ্কার তৈরি করেছে যেগুলোকে 'মিসাইল সিটিস' বলা হয়। এই সামরিক ঘাঁটিগুলি সমুদ্রের किनारे এবং পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত এবং এদের গঠন সম্পূর্ণরূপে গোপন।
এগুলোর শক্তি:
- স্যাটেলাইট এবং রাডার থেকে সুরক্ষা
- মিসাইল এবং অস্ত্রের স্টোরেজ
- আকস্মিক পাল্টা হামলা করার ক্ষমতা
- পরমাণু/রাসায়নিক হামলা থেকেও সুরক্ষা
এই আন্ডারগ্রাউন্ড ঘাঁটিগুলো থেকে ইরান যেকোনো সময় বড় स्तरে মিসাইল লঞ্চ করতে পারে — যা সামরিক রণনীতিতে ‘সারভাইভাল ফোর্স’ হিসাবে কাজ করে।
৪. সাইবার ওয়ারফেয়ার: ডিজিটাল যুদ্ধের অদৃশ্য সেনা
ইরানের সামরিক শক্তি শুধুমাত্র ট্যাঙ্ক এবং মিসাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের একটি শক্তিশালী এবং আক্রমণাত্মক সাইবার আর্মি আছে, যা বিশ্বজুড়ে অনেক হাই-প্রোফাইল সাইবার হামলা করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- সরকারি এবং সামরিক নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশ করার ক্ষমতা
- ইনফ্রাস্ট্রাকচারে (বিদ্যুৎ, যোগাযোগ) সাইবার হামলা
- ডেটা চুরি, সিস্টেম ক্র্যাশ এবং নজরদারির জন্য বিশেষ কোড
স্টাক্সনেট-এর মতো হামলা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইরান তাদের সাইবার ক্ষমতাকে শুধু ডিফেন্সিভ নয়, বরং অফেন্সিভ মোডেও विकसित করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, ইরান এখন বিশ্ব সাইবার যুদ্ধের উদীয়মান নেতা।
ইরানের এই অস্ত্র প্রযুক্তিগুলো এটা স্পষ্ট করে দেয় যে তারা এখন শুধু একটি আঞ্চলিক শক্তি নয়, বরং বিশ্ব সামরিক মানচিত্রে একটি প্রভাবশালী খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। তা সে আত্মঘাতী ড্রোনের বিষয় হোক, ভূগর্ভস্থ মিসাইল বেসের হোক বা সাইবার হামলার – ইরানের এই রণনীতি অসমমিত যুদ্ধের (Asymmetric Warfare) উপর आधारित।