নিজ ঘরেই মিলল ঝুলন্ত দেহ, স্তব্ধ পরিবার
শনিবার সকালে দিলীপবাবুর ঘর থেকে উদ্ধার হয় তাঁর ঝুলন্ত দেহ। বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। পরিবারের বক্তব্য, বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি বলতেন—"আমাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে, এখানে থাকা যাবে না।" তাঁর কথায় ভয় আর অনিশ্চয়তার ছাপ ছিল স্পষ্ট।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন, থেকে গিয়েছিলেন শঙ্কা নিয়েই
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, দিলীপবাবু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন। কলকাতার রিজেন্ট পার্কেই দীর্ঘদিন ধরে বসবাস। ছয় দিদি ও তিনি, একসঙ্গে সীমান্ত পার করে ভারতে আসেন। কলকাতাতেই বিয়ে, সংসার, সন্তানসন্ততি—সবই গড়ে ওঠে। অথচ এত বছরের বসবাসের পরও নাগরিকত্ব নিয়ে যে আশঙ্কা তাঁকে গ্রাস করেছিল, তা শেষ পর্যন্ত প্রাণ কেড়ে নিল।
অশিক্ষক কর্মচারী দিলীপবাবু: কাজের জায়গাতেও হতাশা ছায়া ফেলেছিল
একটি বেসরকারি স্কুলে অশিক্ষক কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন দিলীপবাবু। পরিচিত মহলে একজন পরিশ্রমী ও শান্ত স্বভাবের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু পরিবার জানাচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি ভীষণভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। কারও সঙ্গে সেভাবে কথা বলতেন না, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মাঝেমাঝেই বলতেন, আমাদের ধরে নিয়ে যাবে।
পরিবারের চোখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ, অভিযোগে উঠে এল NRC ইস্যুই
পরিবারের বক্তব্য, ‘তিনি প্রায়ই বলতেন আমাদের হয়তো বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। আমাদের কোনও কাগজপত্র নেই। জন্মসনদও নেই। সবাই তো ছোটবেলায় এসেছি।’ এই কথাগুলো ঘুরেফিরে বলতেন দিলীপবাবু। অবশেষে শনিবার সকালে তাঁর ঘরের দরজা ভেঙে উদ্ধার করা হয় ঝুলন্ত দেহ। তাঁরা বলছেন, এই ভয়ই তাঁর মৃত্যুর কারণ।
‘বিজেপির চক্রান্ত’—তৃণমূল নেতার তোপ, পাল্টা নস্যাৎ বিরোধীর
এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও শুরু হয়েছে। তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী বলেছেন, বিজেপির এনআরসি আতঙ্ক ছড়ানোর কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। মানুষ ভয় পাচ্ছেন, বার্থ সার্টিফিকেট নেই বলে তাঁদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন—“যারা ৫০ বছর আগে এসেছেন, তাঁরা মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট কোথা থেকে আনবেন? পাসপোর্ট কতজনের আছে?
‘মানসিক সমস্যা’, পাল্টা দাবি বিজেপির
তৃণমূলের অভিযোগকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছেন বিজেপি নেতা সজল ঘোষ। তিনি স্পষ্ট বলেন, “এই মৃত্যু দুঃখজনক হলেও, এর সঙ্গে এনআরসির কোনও সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ মানসিক বিষণ্ণতার ঘটনা। রাজনৈতিকভাবে একে ব্যবহার করা অনুচিত।” এনআরসি ইস্যু নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য রাজ্যের শাসক দলকে কাঠগড়ায় তোলেন তিনি।
নাগরিকত্ব নিয়ে ভয়—হৃদয়ের গোপনে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস
একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়, এমন বহু মানুষ কলকাতা ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছেন, যারা বহু বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছেন। অথচ নাগরিকত্বের প্রমাণ, জন্মসনদ, পড়াশোনার শংসাপত্র না থাকায় তাঁদের মধ্যে ভয় লুকিয়ে আছে। এই মৃত্যু যেন সেই আতঙ্কের একটা করুণ প্রতীক।
রিজেন্ট পার্কের প্রতিবেশীরাও হতবাক, শোকস্তব্ধ পরিবার
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দিলীপবাবু সদা হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। তাঁকে এভাবে দেখে কারও সন্দেহ হয়নি। এক প্রতিবেশী বলেন, শুনে তো আমরা স্তম্ভিত। ওর মধ্যে এত ভয় ছিল, আমরা বুঝতেই পারিনি। পরিবারের সদস্যরা এখনও ভেঙে পড়েছেন। স্ত্রী, ছেলে, পুত্রবধূ, নাতনি—সবাই শোকস্তব্ধ। আতঙ্কটা সত্যিই ছিল, এখন তা আরও বড় বাস্তব হয়ে রইল।
মানসিক স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তির জেরে বিপন্ন জীবন
এই ঘটনাটি একটি বড় প্রশ্ন তুলছে—এনআরসি সংক্রান্ত বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক বিতর্ক সাধারণ মানুষের মনে কীভাবে ভয় ও মানসিক চাপ তৈরি করছে? কোনও সরকারি হস্তক্ষেপ বা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিলীপবাবুর কাছে পৌঁছল না। ফলে এক অসহায় মনুষ্য জীবন নিভে গেল, কাগজপত্রের ছাপ না থাকার দুঃস্বপ্নে।