অসমের মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দির: বিশ্বের উচ্চতম শিবলিঙ্গ

অসমের মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দির: বিশ্বের উচ্চতম শিবলিঙ্গ

ভারত ভূমিতে শিব মন্দিরগুলোর পরম্পরা অনাদিকাল থেকে চলে আসছে, তবে কিছু মন্দির এমন হয় যা কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র নয়, বরং নিজের স্বতন্ত্র স্থাপত্যের দ্বারাও বিশ্বজুড়ে ভক্তদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমনই এক দিব্য স্থান হল — মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দির, যা অসমের নগাঁও জেলার পুরণিগুদামের ভরভেরী গ্রামে অবস্থিত। এই মন্দির ভগবান শিবকে উৎসর্গীকৃত এবং এর সবচেয়ে স্বতন্ত্র বিষয় হল — এর নির্মাণ শিবলিঙ্গ রূপে হয়েছে এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু শিবলিঙ্গ (১২৬ ফুট উঁচু) হিসেবে বিবেচিত। এর এই বিশিষ্ট রূপ একে ভারত নয়, পুরো বিশ্বে অদ্বিতীয় করে তোলে।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য: যখন মন্দির স্বয়ং শিবলিঙ্গ হয়ে উঠল

মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এর স্বরূপ। এটি সাধারণ মন্দিরের মতো নয় যেখানে শিবলিঙ্গ গর্ভগৃহে স্থাপিত থাকে, বরং পুরো মন্দির স্বয়ং এক বিশাল শিবলিঙ্গের রূপে নির্মিত। এর উচ্চতা ১২৬ ফুট, এবং এটি নিজের আকৃতিতে সম্পূর্ণরূপে শিবলিঙ্গের প্রতীক। এই মন্দিরের শিল্প এত নিখুঁতভাবে খোদাই করা হয়েছে যে দূর থেকে দেখলে সাধারণ ভক্তেরও এমন আভাস হয় যে সে স্বয়ং মহাদেবের দিব্য স্বরূপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই মন্দির স্থাপত্য বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক সাধনার এক अद्भुत संगम।

ইতিহাস: তপস্যার ভূমি থেকে তীর্থের উদয়

এই মন্দিরের প্রেরণার উৎস হলেন আচার্য ভৃগু গিরি মহারাজ, যিনি ২০০৩ সালে এই স্থানে মন্দির নির্মাণের কল্পনা করেছিলেন। এটি সেই স্থান যেখানে গুরু শুক্রাচার্য প্রাচীনকালে মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জপ ও সাধনা করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্বকে মনে রেখে আচার্য ভৃগু গিরি মহারাজ এই স্থানকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা স্থল হিসেবে নির্বাচিত করেন। ২০০৩ সালে মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করা হয়। বহু ইঞ্জিনিয়ার ও স্থপতির চেষ্টা সত্ত্বেও যখন নির্মাণে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায়নি, তখন এই কাজের প্রযুক্তিগত দায়িত্ব নেন ইঞ্জিনিয়ার নারায়ণ শর্মা। তাঁর প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ভক্তি এই অসাধারণ কাঠামোকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে।

প্রাণ প্রতিষ্ঠা মহোৎসব: যখন পুরো আকাশ মন্ত্রোচ্চারণে মুখরিত হয়ে উঠেছিল

২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত প্রাণ প্রতিষ্ঠা মহোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। এই মহোৎসব নিজের মধ্যে ঐতিহাসিক ছিল, কারণ এতে কেবল ১০৮টি यज्ञ कुंड তৈরি করা হয়নি, বরং তামিলনাড়ু থেকে আসা প্রায় ২৫০ জন বেদपाठी ব্রাহ্মণ यज्ञ ও পূজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই দৃশ্য এমন ছিল যেন ত্রেতা যুগের यज्ञ পুনরায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ থেকে মন্দিরটি সাধারণ ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সহযোগিতা

এই পবিত্র অনুষ্ঠানে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র मंत्री श्री अमित शाह, অসমের তৎকালীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রী ডঃ হিমন্ত বিশ্ব শর্মা (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী), এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী श्री सर्बानंद सोनोवालও উপস্থিত ছিলেন। এই গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতি এই আয়োজনকে একটি জাতীয় গুরুত্বের ধর্মীয় উৎসবে পরিণত করে।

স্থানের বৈশিষ্ট্য: প্রকৃতির কোলে শিবের বাস

এই মন্দির গুয়াহাটি থেকে প্রায় ১২০ কিমি দূরে, নগাঁও জেলার পুরণিগুদামে ভরভেরী গ্রামে অবস্থিত। সবুজ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং গ্রামীণ পরিবেশে অবস্থিত এই মন্দির মন, শরীর ও আত্মাকে শান্তি প্রদানকারী এক স্থান। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এখানে আসেন এবং মন্ত্রোচ্চারণ, ধ্যান, এবং ভগবান শিবের আরাধনার মাধ্যমে আত্মিক শান্তির অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

ভূমিকম্প এবং মন্দিরের দৃঢ়তা

২৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে অসম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে ৬.৭ তীব্রতার একটি ভূমিকম্প হয়, যা অঞ্চলে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দিরের ১২৬ ফুট উঁচু কাঠামোর ওপরও এর প্রভাব পড়েছিল এবং উপরের অংশে সামান্য ফাটল দেখা গিয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে এটি কেবল সাজসজ্জাগত ক্ষতি ছিল, মন্দিরের কাঠামোর ওপর কোনো গুরুতর প্রভাব পড়েনি। এই মন্দির কেবল আধ্যাত্মিক শক্তি নয়, বরং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দক্ষতারও উদাহরণ। এটি দেখায় যে মন্দির কেবল आस्थाর প্রতীক নয়, বরং প্রযুক্তিগত দৃঢ়তারও স্বরূপ হতে পারে।

মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র: এই মন্দিরের সার

এই মন্দির 'ॐ त्र्यम्बकं यजामहे...' দিয়ে শুরু হওয়া মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রকে উৎসর্গীকৃত, যাকে মৃত্যুর ওপর জয় প্রদানকারী মন্ত্র হিসেবে মনে করা হয়। বলা হয় যে এই মন্ত্রের জপ রোগ, ভয়, এবং মৃত্যুর সংকট থেকে মুক্তি দেয়। এই মন্ত্রের কম্পন মন্দির চত্বরে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করা যেতে পারে — সেখানকার বাতাসে এর প্রতিধ্বনি মিশে আছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: পর্যটন ও তীর্থের সঙ্গম

এই মন্দির দেখতে আসা ভক্তদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। অসম সরকার এটিকে একটি ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দিকে কাজ করছে। এর আশেপাশে ধ্যান কেন্দ্র, যোগ কেন্দ্র, ভোজনালয়, এবং বিশ্রাম গৃহ তৈরি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই স্থান পুরো ভারত নয়, বিশ্বজুড়ে শিবভক্তদের তীর্থ হয়ে উঠতে পারে।

সমাজের জন্য অবদান

মন্দির কেবল পূজা-পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মহা মৃত্যুঞ্জয় ट्रस्ट দ্বারা:

  • বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিবিরগুলোর আয়োজন
  • বৃদ্ধদের সহায়তা
  • গৌশালা পরিচালনা
  • ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার
  • স্কুলগুলোতে আধ্যাত্মিক কার্যক্রমের আয়োজন

যেমন সমাজোপযোগী কাজও করা হয়। মন্দির সেবার প্রতীক হয়ে উঠেছে — ঈশ্বরের সেবার পাশাপাশি সমাজেরও।

মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দির কেবল ভগবান শিবের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির কেন্দ্র নয়, বরং এটি দেখায় যে কীভাবে একটি দিব্য স্বপ্ন, সম্মিলিত প্রচেষ্টা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নিষ্ঠাবান সাধনা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যেতে পারে। এই মন্দির একটি প্রতীক — ভক্তি, সংকল্প এবং বিজয়ের। যখনই কোনো ভক্ত এই মন্দিরের বিশাল শিবলিঙ্গ রূপকে দেখে, তার আত্মায় এক শক্তি জাগ্রত হয় — মৃত্যুর ভয়কে জয় করার শক্তি।

Leave a comment