মহারাজা খড়্গ সিং-এর জীবন বীরত্ব, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের প্রতীক ছিল। তাঁর শাসনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও, তাঁর সামরিক দক্ষতা, দয়ালুতা এবং শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা তাঁকে শিখ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য স্থান দিয়েছে। তাঁর জীবন শক্তি ও মানবতার বার্তা দেয়।
খরক সিং: শিখ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে মহারাজা খড়্গ সিং-এর নাম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮০১ সালে লাহোরে হয়েছিল। তিনি ছিলেন মহারাজা রঞ্জিত সিং এবং তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মহারানী দাতার কৌরের বড় পুত্র। খড়্গ সিং-এর জীবনে শক্তি, রাজনৈতিক সংঘাত এবং রহস্যময় ঘটনার এক অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়। তাঁর জীবন এবং শাসনকাল কেবল যুদ্ধ এবং ক্ষমতার সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এতে শিল্প, শিক্ষা এবং ধর্মীয় চেতনারও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
প্রাথমিক জীবন এবং পরিবার
খড়্গ সিং পাঞ্জাবের প্রধান শহর লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা দাতার কৌর নাক্কাই মিসলের প্রধান বংশধর ছিলেন এবং তাঁর পরিবার একটি শক্তিশালী রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তাঁর পিতা, মহারাজা রঞ্জিত সিং, যিনি শিখ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁকে জন্ম থেকেই উত্তরাধিকারী মনে করতেন। তাঁর নাম "খড়্গ", যার অর্থ 'তরবারি চালনাকারী', বিশেষভাবে বীরত্ব ও সাহসের প্রতীক হিসাবে রাখা হয়েছিল। এই নামটি দশম গ্রন্থে বর্ণিত অজেয় যোদ্ধার নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্বাচন করা হয়েছিল।
খড়্গ সিং তাঁর জীবনে চারটি বিবাহ করেন। ১৮১২ সালে ১১ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ চাঁদ কৌরের সঙ্গে হয়, যাঁর থেকে তাঁর এক পুত্র নৌ নিহাল সিং-এর জন্ম হয়। এরপর তাঁর বিবাহ খেম কৌর, কিষাণ কৌর এবং ইন্দার কৌরের সঙ্গে হয়। তাঁর স্ত্রীরা তাঁর জীবন ও সাম্রাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
শিক্ষা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ
খড়্গ সিং-এর লালন-পালন এমন একটি পরিবেশে হয়েছিল যা সামরিক ঐতিহ্য এবং রাজকীয় শৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ ছিল। তিনি খুব অল্প বয়সেই যুদ্ধ এবং সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁকে শেখুপুরা অভিযানে পাঠানো হয়েছিল। ১৮১২ সালে তাঁকে জম্মুর রাজ্য জায়গির হিসেবে দেওয়া হয় এবং বিদ্রোহী সর্দারদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
১৮১৬ সালে, তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করা হয় এবং " টিক্কা কুনওয়ার যুবরাজ " উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর মাতা মাই নাক্কান ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং মুলতান অভিযানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এই প্রশিক্ষণ তাঁকে সামরিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে পারদর্শী করে তোলে।
সামরিক অভিযানে অবদান
খড়্গ সিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। ১৮১৮ সালে, তিনি মুলতানের আফগান শাসক নবাব মুজাফফর খানের বিরুদ্ধে অভিযানে निर्णायक ভূমিকা পালন করেন। মুলতানের বিজয় এবং তারপরে ১৮১৯ সালে শোপিয়ানের যুদ্ধের মাধ্যমে কাশ্মীরকে শিখ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শ্রীনগরে তাঁর নেতৃত্ব কেবল সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তিনি পেশোয়ার বিজয় এবং শিকারপুর অভিযানেও অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর সামরিক দক্ষতা এবং কৌশলগত চিন্তা তাঁকে শিখ সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাপতিদের মধ্যে একজন করে তুলেছিল।
শিখ সাম্রাজ্যের মহারাজা
মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর মৃত্যুর পর খড়্গ সিংকে ১ সেপ্টেম্বর ১৮৩৯ সালে লাহোর দুর্গে সিংহাসনে বসানো হয়। তাঁর শাসনকাল সংক্ষিপ্ত ছিল, কিন্তু ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার মতো ছিল। খড়্গ সিং শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। তিনি সংস্কৃত জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক পাণ্ডুলিপি ‘সর্বসিদ্ধান্ততত্ত্বসিদ্ধমণি’র নির্মাণ করিয়েছিলেন।
যদিও তাঁকে বীর এবং সাহসী মনে করা হত, তবুও তাঁর সরলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে কৌশলগত চতুরতার অভাবের কারণে তাঁকে দুর্বল শাসক হিসাবেও দেখা হত। অস্ট্রিয়ান চিকিৎসক জোহান মার্টিন হোনিগবার্গার তাঁকে বোকা এবং হতবুদ্ধি অবস্থায় থাকা ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও অন্যান্য ঐতিহাসিকরা এটিকে অসত্য মনে করেন এবং তাঁকে দয়ালু, শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী সেনাপতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
খড়্গ সিং-এর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
মহারাজা খড়্গ সিং-এর জীবনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং দরবারের সংঘাত সাধারণ ছিল। তাঁর শিক্ষক চেত সিং বাজওয়া তাঁর উপর এতটাই প্রভাব ফেলেছিলেন যে তাঁকে দরবারে পুতুলের মতো দেখা যেতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী রাজা ধ্যান সিং-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। চেত সিং-এর হত্যা এবং পরে খড়্গ সিংকে বিষ খাওয়ানোর মতো ঘটনা তাঁর শাসনকালের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক ছিল।
রাজা ধ্যান সিং নিজের স্বার্থের জন্য খড়্গ সিংকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে তাঁর ছেলে নৌ নিহাল সিংকে প্রকৃত শাসক বানানোর ষড়যন্ত্র করেন। এর ফলস্বরূপ খড়্গ সিংকে সাদা সীসা এবং পারদ দিয়ে বিষ দেওয়া হয় এবং ৫ নভেম্বর ১৮৪০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
পরিবার এবং উত্তরাধিকারী
খড়্গ সিং-এর স্ত্রীরা এবং তাঁর পুত্র তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন। চাঁদ কৌর তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর পুত্র নৌ নিহাল সিং পরবর্তীতে শিখ সাম্রাজ্যের সিংহাসন লাভ করেন। খেম কৌর এবং কিষাণ কৌরও তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর শেষ স্ত্রী ইন্দার কৌর ব্রিটিশ রাজের সময় পেনশন লাভ করেছিলেন।
তাঁদের পরিবার কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ছিল। তাঁর উত্তরাধিকারী নৌ নিহাল সিং তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনকাল এবং কঠিন পরিস্থিতির ভার সামলেছিলেন।
খড়্গ সিং-এর ভাবমূর্তি এবং অবদান
ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িকদের দৃষ্টিতে খড়্গ সিংকে বিভিন্ন রূপে দেখা হয়েছে। কেউ তাঁকে বোকা এবং দুর্বল শাসক বলেছেন, আবার কেউ তাঁর দয়ালুতা, শিক্ষা, সামরিক দক্ষতা এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রশংসা করেছেন। ক্লাউড মার্টিন ওয়েড এবং ড. প্রিয়া আটওয়াল খড়্গ সিংকে নম্র এবং মানবিক স্বভাবের মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তাঁর ভাবমূর্তি এই কথার প্রতীক যে শক্তি কেবল শাসন করার মাধ্যমে আসে না, বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং মানবতার প্রতি সংবেদনশীলতা থেকেও আসে। তিনি তাঁর শাসনকালে শিল্প, বিজ্ঞান এবং প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
মহারাজা খড়্গ সিং-এর জীবন একটি শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডির মতো ছিল, যেখানে বীরত্ব, শিক্ষা, শক্তি এবং ষড়যন্ত্র সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর শাসনকাল যতই সংক্ষিপ্ত হোক না কেন, তাঁর অবদান এবং ভাবমূর্তি শিখ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে তাঁকে বিশেষ স্থান দিয়েছে। তাঁর জীবন এই কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে একজন শাসকের প্রকৃত ক্ষমতা কেবল যুদ্ধ এবং সামরিক বিজয়ে নয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং মানবতায়ও যাচাই করার যোগ্য।