মহারানা প্রতাপ: রাজপুত বীরের জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস

মহারানা প্রতাপ: রাজপুত বীরের জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাস

ভারতীয় ইতিহাসে এমন অনেক বীর যোদ্ধা হয়েছেন যাঁরা তাঁদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সম্মানের জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে খুব কম নামই আছে যা আজও প্রতিটি ভারতীয়ের হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। মহারানা প্রতাপ এমনই একজন মহান বীর, যাঁর জীবন সংগ্রাম, সাহস এবং নিষ্ঠার উদাহরণ। রাজস্থানের মেওয়ারের এই রাজা মুঘল সম্রাট আকবরের অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং নিজের স্বাধীনতার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এই নিবন্ধে আমরা মহারানা প্রতাপের জীবন, তাঁর সংগ্রাম, যুদ্ধ এবং তাঁর অবদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

প্রাথমিক জীবন এবং সিংহাসন লাভ

মহারানা প্রতাপ ১৫৪০ সালের ১৮ই মে মেওয়ারের রাজা উদয় সিংহ দ্বিতীয় এবং রানি জয়বন্তা বাঈয়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই প্রতাপের মধ্যে সাহস এবং দৃঢ় সংকল্পের ঝলক দেখা যায়। তাঁর তিনজন ছোট ভাই ছিল - শক্তি সিংহ, বিক্রম সিংহ এবং জগমল সিংহ। ১৫৭২ সালে উদয় সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে মেওয়ারের সিংহাসনের জন্য দরবারে বিরোধ হয়। রানি ধীর বাই ভাটিয়ানি তাঁর পুত্র জগমলকে রাজা করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু মেওয়ারের প্রবীণ রাজ-দরবারীরা মহারানা প্রতাপকে রাজ্যাধিকার অর্পণ করেন, কারণ তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় পুত্র। এইভাবে মহারানা প্রতাপ মেওয়ারের ৫৪তম শাসক হিসেবে সিংহাসনে বসেন।

মুঘলদের সঙ্গে প্রাথমিক সংঘর্ষ

সম্রাট আকবর, যিনি সেই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করছিলেন, প্রথমে মহারানা প্রতাপের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে আপস করার চেষ্টা করেন। আকবর বহুবার তাঁকে তাঁর দরবারে আসার এবং তাঁর অধীনস্থ হওয়ার প্রস্তাব দেন, কিন্তু মহারানা প্রতাপ তা প্রত্যাখ্যান করেন। আকবর তাঁর বিরুদ্ধে মনসুর খাঁ, মান সিংহ, রাজা ভগবন্ত দাস এবং তোডার মল প্রমুখ দূত পাঠান, কিন্তু এই সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মহারানা প্রতাপ কোনো ধরনের শর্ত স্বীকার করেননি, তা রাজনৈতিক আনুগত্য হোক, বৈবাহিক জোট হোক বা সশস্ত্র বাহিনীর সংমিশ্রণ হোক।

এমনটা মনে করা হয় যে আকবর এবং মহারানা প্রতাপের মধ্যে বিরোধের একটি বিশেষ কারণ ছিল রাম প্রসাদ নামের একটি হাতি। আকবর বার বার মহারানা প্রতাপের কাছে এই হাতিটি চান, কিন্তু প্রতাপ হাতিটি দিতে অস্বীকার করেন। এই ঘটনা দুজনের মধ্যে আরও উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।

হলদিঘাটির যুদ্ধ

১৫৭৬ সালে মহারানা প্রতাপ এবং মুঘল সেনাবাহিনীর মধ্যে হলদিঘাটির কাছে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই যুদ্ধে মহারানা প্রতাপের কাছে প্রায় ৩,০০০ অশ্বারোহী এবং ৪০০ জন ভিল তীরন্দাজ ছিল, যেখানে মান সিংহের নেতৃত্বে মুঘল সেনার সংখ্যা ছিল প্রায় ১০,০০০। যুদ্ধ তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে, যেখানে মহারানা প্রতাপ আহত হন এবং অবশেষে তাঁকে তাঁর সেনা নিয়ে পার্বত্য এলাকায় পিছু হটতে হয়।

যুদ্ধে মুঘল সেনা জয়ী হয়, কিন্তু মহারানা প্রতাপের বেঁচে থেকে ময়ূরের মতো উড়ে যাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে তাঁর বীরত্বকে অমর করে রেখেছে। বিশেষ করে ঝালা পরিবারের একজন সেনাপতি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে মহারানা প্রতাপের জীবন বাঁচিয়েছিলেন, যার ফলে প্রতাপ যুদ্ধ থেকে পিছু হটার সুযোগ পান। হলদিঘাটির যুদ্ধে মুঘলরা জিতলেও, তারা মহারানা প্রতাপকে ধরতে বা মারতে সফল হয়নি।

হলদিঘাটির যুদ্ধের পরবর্তী সংগ্রাম এবং পুনরুদ্ধার

হলদিঘাটির যুদ্ধের পর মুঘল সেনা মেওয়ারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল যেমন গোগুন্দা, উদয়পুর এবং কুম্ভলগড় দখল করে নেয়। শাহবাজ খান কাম্বোহও বেশ কয়েকবার মেওয়ার আক্রমণ করেন এবং মুঘল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এই আক্রমণগুলির ফলে মহারানা প্রতাপের সামরিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়, কিন্তু তিনি হার মানেননি।

১৫৮৪ সালে আকবর আবারও মেওয়ার আক্রমণ করেন, কিন্তু মহারানা প্রতাপের সেনা তাঁদেরকে পুনরায় পরাজিত করে। এরপর আকবর প্রায় ১২ বছর মেওয়ারের উপর কোনো বড় আক্রমণ করেননি। এই সময়ে মহারানা প্রতাপ তাঁর সেনাকে শক্তিশালী করেন, অনেক অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন এবং মেওয়ারের কৃষি, অর্থনীতি ও বাণিজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন।

কলা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক

মহারানা প্রতাপ কেবল একজন যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি কলা ও সংস্কৃতিরও একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবার ছিল ছাওন্ডে, যেখানে তিনি কবি, চিত্রকর এবং শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই সময়ে ছাওন্ড চিত্রকলার বিকাশ ঘটে, যা রাজস্থানের চিত্রকলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর দরবারে নাসিরুদ্দিনের মতো শিল্পীরা সক্রিয় ছিলেন, যিনি অনেক ধর্মীয় এবং বীরত্বের ছবি এঁকেছেন।

শেষ সময় এবং উত্তরাধিকার

মহারানা প্রতাপের মৃত্যু হয় ১৫৯৭ সালের ১৯শে জানুয়ারি ছাওন্ডে একটি শিকার দুর্ঘটনার কারণে। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর। মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর পুত্র অমর সিংহকে মুঘলদের কাছে কখনো মাথা নত না করার এবং চিতোরগড় পুনরুদ্ধার করার আদেশ দেন। তাঁর জীবনের এই বার্তা আজও ভারতীয় ইতিহাসে স্বাধীনতা ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

সম্রাট আকবর মহারানা প্রতাপের মৃত্যুর খবর শুনে গভীরভাবে শোকাহত হন। মুঘল দরবারের কবি দুর্সা আড়া মহারানা প্রতাপের বীরত্ব ও সংগ্রামকে সম্মান জানিয়ে তাঁর প্রশংসা করেন।

মহারানা প্রতাপের জীবন সাহস, স্বাধীনতা এবং অতুলনীয় সংকল্পের প্রতীক। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের বিশাল চাপের মুখেও নিজের আত্মসম্মান এবং মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য কখনো আপস করেননি। তাঁর সংগ্রাম আজও প্রতিটি ভারতীয়ের হৃদয়ে দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগায় এবং আমাদের শেখায় যে আসল বীরত্ব নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার মধ্যে নিহিত। মহারানা প্রতাপের ইতিহাস সর্বদা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

Leave a comment