রক্ষা বন্ধন প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয়। এই বছর, এই পবিত্র উৎসবটি ৯ই আগস্ট, ২০২৫, শনিবার পড়েছে। এই দিনটি ভাই-বোনের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দিনে বোন তার ভাইয়ের কব্জিতে সুরক্ষার সুতো বাঁধে এবং ভাই তাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। রাখি শুধু একটি সুতো নয়, বরং প্রেম, সুরক্ষা এবং বিশ্বাসের প্রতীক। কিন্তু রক্ষা বন্ধন শুধু পারিবারিক নয়, এটি পৌরাণিক বিশ্বাসের সঙ্গেও জড়িত।
দেবতাদের সময় থেকে চলে আসছে রক্ষা সূত্রের পরম্পরা
রক্ষা সূত্র বাঁধার পরম্পরা অনেক পুরনো বলে মনে করা হয়। ধর্মীয় গ্রন্থেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একটি কাহিনী অনুসারে, দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন অসুরদের পাল্লা ভারী হতে লাগল। দেবরাজ ইন্দ্র যুদ্ধে পরাজয়ের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তখন ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রাণী বৃহস্পতিজির পরামর্শ নিলেন। বৃহস্পতিজি বললেন যে একটি পবিত্র সূত্রকে অভিমন্ত্রিত করে ইন্দ্রের কব্জিতে বেঁধে দাও। ইন্দ্রাণী তেমনই করলেন। এই সূত্রের শক্তিতে ইন্দ্র যুদ্ধে জয়লাভ করলেন। এই ঘটনার পর থেকেই রক্ষা সূত্র বাঁধার পরম্পরা শুরু হয়।
ভগবান বিষ্ণু, রাজা বলি এবং মা লক্ষ্মীর কাহিনী
রক্ষা বন্ধন সম্পর্কিত আরেকটি প্রধান কাহিনী হল ভগবান বিষ্ণু, অসুররাজ বলি এবং মাতা লক্ষ্মীর কাহিনী। যখন ভগবান বিষ্ণু বামন রূপে অবতার নিয়ে রাজা বলির কাছে তিন পা ভূমি চেয়ে তার সমস্ত রাজ্য কেড়ে নিলেন, তখন রাজা বলি তৃতীয় পায়ের জন্য নিজের মাথা এগিয়ে দিলেন। এতে প্রসন্ন হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাকে বর দিলেন যে তিনি পাতালে রাজা বলির সঙ্গে থাকবেন।
যখন বিষ্ণুজি পাতালে থাকতে শুরু করলেন, তখন লক্ষ্মীজি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তখন তিনি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণীর রূপ ধারণ করে রাজা বলির কাছে পৌঁছলেন। সেখানে তিনি রক্ষা সূত্র বাঁধলেন এবং ভগবান বিষ্ণুকে তাঁর সঙ্গে বৈকুণ্ঠে নিয়ে যাওয়ার প্রার্থনা করলেন। বলি রাখির সম্মান রাখলেন এবং তাঁকে যেতে দিলেন। সেই থেকে এই পরম্পরা চলে আসছে যে রাখির বন্ধন যে কোনও প্রতিশ্রুতি বা সম্পর্কের ঊর্ধ্বে।
রানি কর্ণাবতী এবং হুমায়ুনের ঐতিহাসিক ঘটনা
ইতিহাসেও রক্ষা বন্ধনের উদাহরণ পাওয়া যায়। সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি হল মেওয়ারের রানি কর্ণাবতী এবং মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের। যখন গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ মেওয়ার আক্রমণ করেন, তখন রানি কর্ণাবতী হুমায়ুনকে একটি রাখি পাঠান এবং সাহায্যের আবেদন জানান। হুমায়ুন রাখির সম্মান রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে রানীর সাহায্যে রওনা হন। এই ঘটনাটি এটাই প্রমাণ করে যে রাখি শুধু রক্তের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি আবেগপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি করে।
কৃষ্ণ ও দ্রৌপদীর বন্ধুত্বেও জড়িয়ে রাখি
মহাভারত কালের একটি কাহিনীতেও রক্ষা সূত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। একবার শ্রীকৃষ্ণের আঙুলে আঘাত লাগার কারণে রক্ত ঝরতে শুরু করে। দ্রৌপদী তাঁর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শ্রীকৃষ্ণের আঙুলে বেঁধে দেন। শ্রীকৃষ্ণ আবেগাপ্লুত হয়ে প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি জীবনভর তাঁকে রক্ষা করবেন। পরে বস্ত্রহরণের সময় যখন দ্রৌপদী শ্রীকৃষ্ণকে ডাকেন, তখন তিনি তাঁর মায়া দিয়ে তাঁর সম্মান বাঁচান। এই সম্পর্ক একটি সত্যিকারের বন্ধুত্ব এবং রক্ষা সূত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে।
রক্ষা সূত্র বাঁধার পরম্পরা এখনও জীবিত
আজও গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত, সর্বত্র রক্ষা সূত্র বাঁধার এই পরম্পরা পুরো উল্লাস ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। রক্ষা সূত্র কেবল ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, অনেক সময় বোনেরা তাদের তুতো, মামাতো বা বন্ধুভাবাপন্ন ভাইদেরও রাখি বাঁধে। এমনকি, কিছু লোক তো গাছ, সৈনিক বা গরুদেরও রাখি বাঁধে, যা এই উৎসবকে একটি ব্যাপক সামাজিক অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত করে।
রক্ষা বন্ধন কেবল হিন্দু ধর্মে নয়, বরং ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিতেও পালিত হয়। বাংলায় একে ঝুলন পূর্ণিমা বলে, আবার দক্ষিণ ভারতে এই উৎসব অবনী অবিত্তম রূপে পরিচিত। উত্তর ভারতে এই দিনে গঙ্গা স্নান ও যজ্ঞাদির আয়োজনও হয়।
রক্ষা বন্ধন আসা মাত্রই বাজারে রাখির বাহার দেখা যায়। বোনেদের জন্য রাখির অনেক রকমের সম্ভার থাকে। ভাই-বোনেরা একে অপরের জন্য উপহার কেনে। মিষ্টির দোকানে ভিড় বেড়ে যায়। এই দিনটি আনন্দ ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়, যেখানে পুরো পরিবার এক সাথে থাকে।