নাগ পঞ্চমী: ঐতিহ্য, পূজা ও ভক্তদের ভক্তিপূর্ণ উদযাপন

নাগ পঞ্চমী: ঐতিহ্য, পূজা ও ভক্তদের ভক্তিপূর্ণ উদযাপন

প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে পালিত হওয়া নাগ পঞ্চমী এইবার ২৯শে জুলাই শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে পালিত হচ্ছে। ভারতের অনেক রাজ্যে সকাল থেকেই মন্দিরগুলোতে ভক্তদের লম্বা লাইন দেখা গেছে। এই দিনে নাগ দেবতার পূজার পাশাপাশি ভগবান শিবের রুদ্রাভিষেকও করা হয়। লোকেরা বাড়িতে এবং মন্দিরে দুধ, চন্দন, কেশর এবং ফুল দিয়ে নাগ দেবের পূজা করছেন।

নাগদের পূজার গুরুত্ব

সনাতন পরম্পরায় নাগদের পৃথিবীর রক্ষক এবং শক্তির প্রতীক মানা হয়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে নাগ পঞ্চমীর দিনে যে ব্যক্তি সাੱਚা মনে নাগদের পূজা করে, তার জীবন থেকে সর্প দোষ এবং ভয় দূর হয়ে যায়। এই কারণে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরের মন্দির পর্যন্ত, সর্বত্র আজকের দিনে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়েছে।

নাগ পঞ্চমীতে ধ্বনিত বিশেষ মন্ত্র

নাগ পঞ্চমীর দিনে বিশেষ মন্ত্র জপ করা অত্যন্ত শুভ বলে মানা হয়। ভক্তরা সকালের দিকে নাগ দেবতাকে কেশর মিশ্রিত দুধ অর্পণ করে 'ওঁ নাগরাজায় নমঃ' মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। অনেক ভক্ত কালসর্প দোষ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য 'ওঁ ক্রৌং নমো অস্তু সর্পেভ্যো কালসর্প শান্তি কুরু কুরু স্বাহা' মন্ত্র ১০৮ বার জপ করেছেন। এই মন্ত্রोच्चারণে মন্দির চত্বরের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভক্তিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

শিব যোগ ও সিদ্ধ যোগ দিনটিকে বিশেষ করে তুলেছে

এইবার নাগ পঞ্চমীতে দুটি শুভ যোগের সংযোগ ঘটেছে। একদিকে শিব যোগ এবং অন্যদিকে সিদ্ধ যোগ এই দিনের মাহাত্ম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পণ্ডিতদের মতে এমন সংযোগ বহু বছর পর হয়, এবং এই দিনে করা পূজা অত্যন্ত ফলদায়ক বলে মানা হয়। এই কারণে ভক্তরা বিশেষভাবে রুদ্রাভিষেক, নাগ মন্ত্রের জপ এবং ব্রত রেখে এই দিনটিকে পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেছেন।

নাগদের সঙ্গে জড়িত পৌরাণিক কাহিনী

নাগ পঞ্চমীর উল্লেখ অনেক পুরাণ এবং গ্রন্থে পাওয়া যায়। বলা হয় যে মহাভারত কালে যখন জনমেজয় তার পিতা পরীক্ষিতের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নাগ যজ্ঞ শুরু করেছিলেন, তখন তক্ষক নাগকে বাঁচানোর জন্য আস্তিক মুনি এই যজ্ঞ বন্ধ করিয়েছিলেন। সেই ঘটনার স্মৃতিতে নাগ পঞ্চমী পালন করা হয়। এছাড়া ভগবান শিবের অলঙ্কারও সর্প, এবং বিষ্ণু ভগবান শেষনাগের উপর শয়ন করেন। সেইজন্য নাগদের পূজার বিশেষ গুরুত্ব আছে।

পূজার ঐতিহ্যপূর্ণ বিধি

এই দিনে নাগ দেবতাকে দুধ, কেশর, ফুল, অক্ষত এবং চন্দন অর্পণ করা হয়। মাটি বা রূপার নাগ-নাগিনীর মূর্তি বানিয়ে বা কিনে তার পূজা করা হয়। মহিলারা বিশেষভাবে ব্রত রাখেন এবং পরিবারের সুখ-শান্তি কামনা করেন। কিছু স্থানে সাপের বিশেষ শোভাযাত্রা এবং মেলারও আয়োজন করা হয়, যেখানে সাপ দেখার জন্য ভিড় জমে।

শুভেচ্ছাবার্তার পালা দিনভর জারি

সোশ্যাল মিডিয়া এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মে আজ নাগ পঞ্চমীর শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক ছিল। লোকেরা একে অপরকে বার্তা পাঠাচ্ছেন যেমন -

  • "নাগ পঞ্চমীর এই পবিত্র উৎসবে ভগবান শিব এবং নাগ দেবতার কৃপা সর্বদা বজায় থাকুক"
  • "এই নাগ পঞ্চমীতে আপনার জীবন থেকে সকল দোষ দূর হোক এবং সুখ-শান্তির বাস হোক"
  • "শিব শঙ্করের প্রিয় নাগরাজের আশীর্বাদ সর্বদা আপনার উপর থাকুক"

এছাড়াও লোকেরা নিজেদের ঘরের পূজার ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করছেন, যা থেকে উৎসবের উৎসাহ ডিজিটাল দুনিয়াতেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

মন্ত্রের জপ পূজার প্রধান অংশ

পুরো দেশে আজ নাগ পঞ্চমীতে বিশেষ মন্ত্র জপ করা হয়েছে। মন্দিরগুলোতে 'নাগেন্দ্রহারায় ত্রিলোচনায় ভস্মাঙ্গ রাগায় মহেশ্বরায়' এবং 'ওম নবকুলায় বিদ্মহে, বিষদন্তায় ধীমহি, তন্নো সর্প প্রচোদয়াৎ' এর মতো মন্ত্র ধ্বনিত হয়েছে। এই মন্ত্র বিশেষ করে কালসর্প দোষ থেকে মুক্তি, স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধির জন্য বলা হয়। কিছু ভক্ত নব নাগের নামও পাঠ করেছেন - অনন্ত, বাসুকী, শেষ, পদ্ম, কম্বল, শঙ্খপাল, ধৃতরাষ্ট্র, তক্ষক এবং কালিয়া।

পরিবেশ এবং নাগদের সুরক্ষার বার্তা

নাগ পঞ্চমী শুধু পূজার উৎসব নয়, এটি পরিবেশ রক্ষারও প্রতীক হয়ে উঠছে। আজকের দিনে লোকেরা সাপের প্রতি করুণা ও সুরক্ষার ভাবনাও প্রকাশ করেন। অনেক সামাজিক সংস্থা এই উপলক্ষে মানুষকে সাপ না মারার এবং তাদের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য অভিযানও চালায়।

গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত নাগ পঞ্চমীর ছায়া

উত্তর ভারতের রাজ্য যেমন উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান এবং মহারাষ্ট্রে নাগ পঞ্চমী খুব ধুমধাম করে পালিত হয়েছে। সকাল থেকে মন্দিরগুলোতে ভিড় এবং বাড়িতে পূজার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। মহিলারা ঐতিহ্যপূর্ণ পোশাকে পূজা করতে দেখা গেছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতেও এই উৎসব আলাদা আঙ্গিকে পালিত হয়, যেখানে বিশেষভাবে নাগ মন্দিরে প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করা হয়।

উৎসবের রঙে রাঙা ভক্তরা, সর্বত্র ভক্তিপূর্ণ পরিবেশ

শ্রাবণের এই পবিত্র মাসে নাগ পঞ্চমীর মতো উৎসব ভক্তদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব রাখে। ভগবান শিবের কৃপা পাওয়ার এই সুযোগ ভক্তদের জন্য বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধায় ভরা থাকে। এই দিনে নাগ দেবতার আরাধনা করলে মানুষের মানসিক শান্তি এবং ইতিবাচক শক্তি পাওয়া যায়।

Leave a comment