রবীন্দ্রসঙ্গীতের পথে বিশ্বাসের ভরসা, কিন্তু শ্রোতার অভ্যাসে খামতি
শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য বরাবরই নিজের অবস্থানকে প্রচারের আলো থেকে দূরে রাখতে পছন্দ করেন। তবে তাঁর কণ্ঠে যে সুর বয়ে চলে, তা হাজারো হৃদয়ে আজও দোলা দেয়। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে শ্রীকান্ত স্পষ্ট জানালেন, রবীন্দ্রচেতনা তো সকলের মধ্যে থাকবে না, কোনওকালেই ছিল না। মানুষের অভ্যাস এবং মননের মধ্যে যে সংকীর্ণতা ঢুকে পড়েছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিল্পী।
‘গায়ের জোরে রবীন্দ্রনাথের ভোল পাল্টে দেওয়া যায় না’ — স্পষ্ট মত শিল্পীর
বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ শ্রোতা কেবল পরিচিত কয়েকটি গানেই ঘোরাফেরা করেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের গান একটা সমুদ্র—শ্রীকান্ত মনে করিয়ে দিলেন সেই বিস্তারের কথা। তাঁর মতে, “আমরা শিল্পীরা যদি শুধু অনুষ্ঠান সফল হবে কি না ভেবে কাজ করি, তাহলে তা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।” তাই তিনি স্টেজে বেছে নিচ্ছেন সেই সব গান, যেগুলো তথাকথিত জনপ্রিয় গানের তালিকায় পড়ে না।
সৃষ্টি বড়, কিন্তু শ্রোতার মনন সীমিত — নতুন প্রজন্ম নিয়ে আশঙ্কা
রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূলে রয়েছে গভীরতা ও সৌন্দর্য, যা আজকের প্রজন্ম ঠিকভাবে উপলব্ধি করছে না বলেই মনে করেন শিল্পী। তাঁর মতে, “এত ব্যাপক সৃষ্টি শোনার অভ্যাসও তো বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে নেই।” গানের মধ্যে যে ধ্যান ও চিন্তার গভীরতা, তা উপভোগ করার জন্য প্রয়োজন অন্তর্দৃষ্টি। কিন্তু সেই মনন তৈরির চর্চা আজ অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে।
‘নতুন প্রজন্ম যদি রবীন্দ্রচিন্তায় না ডুবে, তবে দুঃখের’ — বললেন শ্রীকান্ত
নবীন শ্রোতাদের রবীন্দ্রনাথের গানের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পরিচিত করানোই শ্রীকান্তের লক্ষ্য। তিনি চান, অনুষ্ঠান শুনে অন্তত একজন শ্রোতারও চেতনায় পরিবর্তন আসুক। সেটা হলেই নিজেকে সার্থক মনে করবেন। তবে এই প্রজন্মের মধ্যে রবীন্দ্র-অনুভবের যে সঙ্কোচ, তা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। গায়ের জোরে সেই ভোল পাল্টালে আসল ভাবটা নষ্ট হয়,— বলেন তিনি।
বাংলা ভাষার অবমাননায় ক্ষুব্ধ শ্রীকান্ত, চোখে জল এনে দেয় পথঘাটের দৃশ্য
বাংলা ভাষা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন শ্রীকান্ত। তাঁর মতে, শিক্ষার অভাবে ও সংস্কৃতি চর্চার ঘাটতিতে আজ বাংলা ভাষা অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে, বিজ্ঞাপনে বা সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহারের যে করুণ দশা, তা দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে তাঁর। “বাংলা ভাষার প্রতি কোনও শ্রদ্ধা চোখে পড়ে না”— বলে ক্ষোভ উগরে দেন তিনি।
সংস্কৃতি যখন প্রহসনে পরিণত হয়, তখন শিল্পীর কণ্ঠে জেগে ওঠে প্রতিবাদ
ভাষা ও সঙ্গীতের এই অবমাননার বিরুদ্ধে শ্রীকান্ত আচার্যের বক্তব্য যেন এক প্রতিবাদী সুরে ভরপুর। সমাজ যখন সংস্কৃতিকে কেবল বিনোদনের দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখনই এমন শিল্পীরাও আওয়াজ তোলেন, যাঁরা গানের আড়ালে থেকে নিজেদের কাজটা নিঃশব্দে করে যান। “আমার লজ্জা করে—এই ছোট্ট বাক্যেই যেন ফুটে উঠেছে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অদম্য ভালবাসা এবং যন্ত্রণার মর্মর ধ্বনি।