যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব: প্রযুক্তি, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ

🎧 Listen in Audio
0:00

আজকাল যুদ্ধের ক্ষেত্রে ড্রোন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর অংশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এগুলো শুধুমাত্র গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করে না, বরং দ্রুত ও নির্ভুল আক্রমণও চালায়, যা শত্রুর অবস্থানকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে।

প্রযুক্তি: আজকের যুদ্ধে যেখানে সৈন্য ও অস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম, সেখানে ড্রোন (UAVs) যুদ্ধের চিত্র সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে। একসময় যুদ্ধ শুধুমাত্র স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন ড্রোন আকাশ থেকে ভূমি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তার শক্তি প্রমাণ করেছে। এগুলো শুধুমাত্র শত্রুপক্ষের এলাকায় সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে না, বরং আক্রমণাত্মক ড্রোন যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শুধুমাত্র যুদ্ধের কৌশলগত ধারা পরিবর্তন করছে না, বরং আগামী দিনগুলিতে একে যুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকর শক্তি হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

ড্রোনের ইতিহাস: প্রথম ব্যবহার থেকে আজ পর্যন্ত

ড্রোনের ইতিহাস ১০০ বছরের পুরোনো। এর প্রথম ব্যবহার ১৯১৪-১৯১৮ সালের মধ্যে, অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হয়েছিল, যখন ব্রিটেন এবং আমেরিকা পাইলটবিহীন বিমানের উন্নয়ন শুরু করেছিল। তবে, এই প্রাথমিক ড্রোন মডেলগুলি যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি, তবে এগুলিকে রিমোট-কন্ট্রোল ফ্লাইটের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৩৫ সালে ব্রিটেন 'কুইন বি' নামক রিমোট-কন্ট্রোল ড্রোন তৈরি করে, এবং এর থেকেই ড্রোন শব্দটির উৎপত্তি।

১৯৫০-৬০-এর দশকে আমেরিকা গোয়েন্দা কাজে ড্রোন ব্যবহার শুরু করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ছোট ছোট ড্রোন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে ড্রোনের উড়ান ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এগুলিকে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত আকাশে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯০-এর দশকে, রিয়েল-টাইম স্যাটেলাইট ডেটা ড্রোনকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল এবং ২০০০ সালে আমেরিকা 'প্রিডেটর ড্রোন'কে অস্ত্রধারী করে তোলে, যা শুধুমাত্র গোয়েন্দা কাজই করতে পারে না, বরং যুদ্ধে আক্রমণাত্মকও হতে পারে।

ভারতে ড্রোনের আবির্ভাব

ভারত প্রথম ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে ড্রোনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। সেই সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীকে শত্রুর অবস্থানের সঠিক অনুমানের জন্য গোয়েন্দা বিমানের প্রয়োজন ছিল। কার্গিল যুদ্ধের পর ভারত ইসরাইল থেকে 'সার্চার' এবং 'হেরন' ড্রোন কিনেছিল, যা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর অবস্থানের সঠিক তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।

ভারত ইসরাইল থেকে 'হারপি' ড্রোনও কিনেছিল, যা রাডার ধ্বংস করতে সক্ষম ছিল। এই ড্রোনটি ভারত 'অপারেশন সিন্দুর'-এ পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করেছিল। ২০০৯ সালে ভারত 'হারোপ' ড্রোন কিনেছিল, যা তার ক্ষমতার মাধ্যমে শত্রুর রাডারে আক্রমণ করে তাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে।

২০২১ সালে ভারত ইসরাইল থেকে 'হেরন TP/মার্ক ২' ড্রোন কিনেছে, যা দীর্ঘ সময় উড়ান এবং ভারী অস্ত্র বহন করতে সক্ষম। একই সাথে, ভারত সম্প্রতি আমেরিকা থেকে 'MQ-9B সিগার্জিয়ান' ড্রোন ভাড়া করেছে। এই ড্রোনগুলি বিশেষ করে পাকিস্তান এবং চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ড্রোনের ব্যবহার: কৌশল ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন

ড্রোনের সাহায্যে যুদ্ধের কৌশলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যেখানে একসময় শত্রুপক্ষের এলাকায় ঢুকে যুদ্ধ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেখানে এখন ড্রোনের মাধ্যমে সৈন্যদের মাঠে নামানো ছাড়াই নির্ভুল আক্রমণ করা সম্ভব। যুদ্ধের এই নতুন প্রযুক্তি সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হচ্ছে।

ভারতে ড্রোনের ব্যবহার শুধুমাত্র গোয়েন্দা ও আক্রমণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামরিক অভিযানের গতি ও নির্ভুলতাও বৃদ্ধি করছে। সম্প্রতি ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে ড্রোনের মাধ্যমে আক্রমণ করেছে, যেখানে 'হারোপ' ড্রোন শত্রুর রাডার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করেছিল।

ভবিষ্যতে ড্রোনের ভূমিকা

যুদ্ধে ড্রোনের ভূমিকা ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। এগুলো শুধু গোয়েন্দা যন্ত্র নয়, বরং যুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। ইলন মাস্ক-এর মতো প্রযুক্তিবিদরাও মনে করেন ভবিষ্যতের যুদ্ধে ড্রোনের অবদান অপরিসীম হবে। সাইবার সুরক্ষা ও ড্রোন-বিরোধী প্রযুক্তির উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে ড্রোন যুদ্ধের ভবিষ্যতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, এবং এটি মাত্র শুরু।

আজকের যুদ্ধে ড্রোন তার শক্তি ও প্রভাব প্রমাণ করেছে। চাই ভারত-পাকিস্তান সংঘাত হোক বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সর্বত্র ড্রোন তার গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। আগামী দিনগুলিতে ড্রোনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে যুদ্ধের ধরন আরও বেশি পরিবর্তিত হতে পারে, এবং এটি একটি নতুন যুদ্ধ কৌশলের সূচনা হতে পারে।

Leave a comment