অর্ধশতক পর বাজারে খেসারি ডাল বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা—শরীরে আনতে পারে পক্ষাঘাত

অর্ধশতক পর বাজারে খেসারি ডাল বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা—শরীরে আনতে পারে পক্ষাঘাত

ভারতীয় খাদ্যতালিকায় ডালের গুরুত্ব

ভারতে শাকসবজি, মাছ, মাংস বা ডিমের মতোই ডাল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের উৎস। বিশেষ করে নিরামিষাশীদের জন্য এটি অমূল্য খাদ্য। মুগ, ছোলা, অড়হর কিংবা মসুর—সব ডালই নিয়মিত খাওয়া হয় প্রায় প্রতিটি ঘরে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে উঠেছে ভেজাল ডালের দাপট। এক জনপ্রিয় চিকিৎসক জানিয়েছেন, ভেজাল মসুর ডাল খেয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছেন এক ব্যক্তি। এই সতর্কবার্তা নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।

মর্মান্তিক ঘটনা ঘিরে আতঙ্ক

সম্প্রতি চিকিৎসক ধমিজা এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা তুলে ধরেছেন। ২৪ বছরের এক বডি বিল্ডার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। দুর্বলতা, হাঁটতে অসুবিধা এবং গাঢ় প্রস্রাব—এই সব লক্ষণ নিয়ে তিনি চিকিৎসকের কাছে আসেন। পরে জানা যায়, নিয়মিত প্রোটিনের জন্য তিনি যে ডাল খেতেন, সেটি ছিল ভেজাল মিশ্রিত। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর সমস্যার সূত্রপাত।

ভেজালে ভরল মসুর ডাল

চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ওই ব্যক্তির কেনা মসুর ডাল আসলে ভেজালযুক্ত ছিল। ডালের মধ্যে থাকা বিষাক্ত যৌগ তাঁর স্নায়ুতন্ত্রকে আঘাত করে এবং পক্ষাঘাতের মতো মারাত্মক জটিলতা ডেকে আনে। সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিদিনকার প্রোটিনের উৎস হলেও এই ভেজাল মসুর ডাল জীবনঘাতী হয়ে উঠছে।

খেসারি ডালের বিপজ্জনক উপস্থিতি

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে উত্তর ভারতে বহুল ব্যবহৃত খেসারি ডাল মূলত সস্তা দামের কারণে জনপ্রিয়। এটি দেখতে অনেকটা কান্দি ডালের মতো। কিন্তু চিকিৎসক ধমিজার দাবি, বাজারে এই খেসারি ডাল ভেজালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে থাকা রাসায়নিক যৌগ সরাসরি স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে এবং ভয়ঙ্কর স্নায়ুজনিত রোগের কারণ হয়।

ডালের সঙ্গে লুকিয়ে থাকা বিষ

খেসারি ডালে স্বাভাবিকভাবেই থাকে ডাই-অ্যামিনো-প্রো-পায়োনিক অ্যাসিড নামক এক মারাত্মক পদার্থ। এর ফলেই হয় ল্যাথিরিজম নামে পরিচিত রোগ। এই রোগে শরীরের নিম্নাঙ্গে পক্ষাঘাত দেখা দেয়। নিয়মিতভাবে দীর্ঘদিন খেলে এর ক্ষতি হয়ে ওঠে স্থায়ী। গবেষণা বলছে, ছ’মাস ধরে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ গ্রাম খেলে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিপর্যয়।

সরকারি নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস

অনেক মানুষ এই ডাল খেয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ায় ভারত সরকার ১৯৬১ সালে খেসারি ডালের উপর আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে ব্যবসায়ীরা ফাঁক খুঁজে নেন অন্যভাবে। বেশি লাভের জন্য মসুর ডালের সঙ্গে মিশিয়ে দেন খেসারি। কখনও আবার মেটানিল হলুদের মতো কৃত্রিম রঙ ব্যবহার করে সাধারণ ডালকে ‘চমকদার’ করে তোলা হয়। ফলে সাধারণ ক্রেতারা প্রতারিত হন অজান্তেই।

স্বাস্থ্যঝুঁকির পরিণতি

এই ভেজাল ডাল শরীরের জন্য একেবারেই নিরাপদ নয়। চিকিৎসকেরা সতর্ক করে বলেছেন—এতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে, স্নায়বিক সমস্যা তৈরি হতে পারে, আবার পেটের রোগও দেখা দিতে পারে। তাই রাস্তার ধারে অল্প দামে পাওয়া মসুর ডাল না কেনারই পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভেজাল শনাক্ত করার কৌশল

ডালের গন্ধ বা স্বাদে যদি অস্বাভাবিকতা থাকে—যেমন অদ্ভুত গন্ধ বা তেতো স্বাদ—তাহলেই বুঝতে হবে ডাল ভেজালযুক্ত। সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হল সিল করা প্যাকেটজাত শীর্ষ ব্র্যান্ডের ডাল কেনা। কেনার সময় অবশ্যই প্যাকেজে FSSAI লাইসেন্স নম্বর ও AGMARK সার্টিফিকেশন খুঁজে দেখতে হবে। এছাড়া উৎপাদনের তারিখও পরীক্ষা করা জরুরি।

সন্দেহ হলে অভিযোগ জানান

যদি কোনওভাবে সন্দেহ হয় ডাল ভেজাল মেশানো, তবে অবিলম্বে অভিযোগ করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা দপ্তরে। FSSAI ফুড সেফটি কানেক্ট পোর্টাল বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও অভিযোগ জানানো সম্ভব। সাধারণ ভোক্তাদের সচেতনতা ও পদক্ষেপই এই খাদ্য ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারে।

উপসংহার

খাবার আমাদের শরীরের জ্বালানি, আর ডাল প্রোটিনের সহজতম উৎস। কিন্তু খেসারি ডালের মতো নিষিদ্ধ খাদ্য যখন ফের বাজারে জায়গা করে নেয়, তখন বিপদের ঘণ্টা বাজে। পক্ষাঘাত থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী স্নায়বিক সমস্যার ঝুঁকি—সবই লুকিয়ে আছে এই ডালের মধ্যে। তাই সচেতন কেনাকাটাই হতে পারে একমাত্র সমাধান।

Leave a comment