দেবশয়নী একাদশী: মন্ত্র জপ ও তাৎপর্য

দেবশয়নী একাদশী: মন্ত্র জপ ও তাৎপর্য

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে পালিত হওয়া দেবশয়নী একাদশীর ব্রত এবার ৬ই জুলাই, ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। এই দিনটি ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হয় এবং এই দিন থেকেই চাতুর্মাস শুরু হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, দেবশয়নী একাদশী থেকে ভগবান বিষ্ণু ক্ষীর সাগরে যোগনিদ্রায় যান এবং চার মাস পর দেবোত্থানী একাদশীতে জেগে ওঠেন। এই চার মাসকে চাতুর্মাস বলা হয়, যা শুভ কাজের জন্য অশুভ সময় হিসেবে গণ্য করা হয়।

এই বিশেষ দিনে ভগবান বিষ্ণুর মন্ত্র জপ করা অত্যন্ত ফলদায়ক বলে মনে করা হয়। ধর্মগ্রন্থ ও সাধুদের মতে, এই মন্ত্রগুলি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সঙ্গে জপ করলে জীবনে সুখ আসে, মানসিক চাপ কমে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়।

দেবশয়নী একাদশীর তারিখ ও সময়

পঞ্জিকা অনুসারে, দেবশয়নী একাদশীর তিথি ৫ই জুলাই, ২০২৫ তারিখে সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিটে শুরু হয়ে ৬ই জুলাই রাত ৯টা ১৪ মিনিট পর্যন্ত থাকবে। উদয়া তিথি অনুসারে, এই ব্রত ৬ই জুলাই পালন করা হবে। এই দিনে ব্রত-উপবাস, বিষ্ণু পূজা, মন্ত্র জপ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

ভগবান বিষ্ণুর প্রধান মন্ত্র যা জপ করা উচিত

এই একাদশীতে ভগবান বিষ্ণুর পূজা করার সময় বিশেষ মন্ত্র জপ করা শুভ বলে মনে করা হয়। এই মন্ত্রগুলি শুদ্ধ উচ্চারণে, মনোযোগ সহকারে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে জপ করলে মন শান্ত হয় এবং ভগবানের কৃপা লাভ হয়।

১. ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়

এটি ভগবান বিষ্ণুর মূল বীজ মন্ত্র। এই মন্ত্র জপ করলে নেতিবাচক শক্তি দূর হয়, মন শান্ত হয় এবং গৃহে সুখ-শান্তি আসে। এটি তুলসী মালা দিয়ে ১০৮ বার জপ করার প্রথা প্রচলিত আছে। বলা হয়, যে ভক্ত এই মন্ত্রটি শ্রদ্ধার সাথে জপ করেন, তিনি ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ কৃপা লাভ করেন।

২. ওঁ শ্রী বিষ্ণবে চ বিদ্মহে বাসুদেবায় ধীমহি। তন্নো বিষ্ণুঃ প্রচোদয়াৎ॥

এই মন্ত্র ভগবান বিষ্ণুর মহিমা বর্ণনা করে এবং তাঁর কাছে বুদ্ধি, জ্ঞান ও বিবেক প্রার্থনা করে। এটি গায়ত্রী মন্ত্রের মতো এবং এটি জপ করলে ব্যক্তি জীবনের দিশা খুঁজে পায়। বিশেষ করে ছাত্র এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের জন্য এই মন্ত্রটি অত্যন্ত উপযোগী।

৩. ওঁ নমো নারায়ণায়

এই মন্ত্র নারায়ণ স্বরুপ বিষ্ণু ভগবানকে উৎসর্গীকৃত। এই মন্ত্র জপ করলে মানসিক শান্তির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ভয়ও দূর হয়। এটি জপ করলে জীবনে সুরক্ষা, সমৃদ্ধি এবং ইতিবাচক শক্তি আসে। এই মন্ত্রটি বিশেষ করে সেইসব মানুষের জন্য উপযোগী যারা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।

৪. হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

এটি ‘হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র’ নামে পরিচিত এবং কলিযুগে সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। এই মহামন্ত্র জপ করলে মন নির্মল হয়, আত্মা শান্তি পায় এবং জীবনে ভক্তির অনুভূতি গভীর হয়। এটি ভজন ও কীর্তনেও গাওয়া হয়।

পূজার সময় এই বিষয়গুলির প্রতি মনোযোগ দিন

দেবশয়নী একাদশীর দিন যখন আপনি এই মন্ত্রগুলি জপ করবেন, তখন কিছু নিয়ম পালন করা জরুরি। জপ করার আগে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরুন। শান্ত ও নির্জন স্থানে কুশাসন বা উলের আসন পেতে বসুন। তুলসী মালা দিয়ে জপ করা বিশেষ ফলদায়ক। এছাড়াও, জপ করার সময় মনে একাগ্রতা এবং শ্রদ্ধা বজায় রাখুন।

সকাল ও সন্ধ্যায় পূজার সাথে এই মন্ত্রগুলি জপ করলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। ভক্তরা চাইলে পূজার পর ভগবান বিষ্ণুকে শয়ন অবস্থায় স্থাপন করার সময় একটি বিশেষ মন্ত্র জপ করতে পারেন, যার মাধ্যমে তাঁর শয়নকালে সমগ্র বিশ্বে ভারসাম্য বজায় থাকবে।

দেবী লক্ষ্মীর কৃপা লাভের জন্য জপ করুন

যেহেতু ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীর সম্পর্ক রয়েছে, তাই এই দিনে তাঁর মন্ত্র জপ করাও উপকারী। এর ফলে গৃহে ধন-সম্পদ, সুখ-সুবিধা ও ঐশ্বর্যের বৃদ্ধি ঘটে। লক্ষ্মী মন্ত্রের সঙ্গে বিষ্ণু মন্ত্রের সম্মিলিত জপ সাধককে আধ্যাত্মিক এবং भौतिक উভয় স্তরে সমৃদ্ধ করে।

চাতুর্মাসের সূচনা ও ঐতিহ্য

দেবশয়নী একাদশীর সঙ্গে সঙ্গে চাতুর্মাস শুরু হয়। এই চার মাসের সময়কালকে ভগবান বিষ্ণুর নিদ্রা সময় হিসেবে ধরা হয়, যা বিবাহ, গৃহপ্রবেশ, মুন্ডন, উপনয়ন-এর মতো শুভ কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। এই মাসগুলিতে উপবাস, ভজন, কীর্তন, সেবা ও সাধনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

ধর্মীয় পরিবেশ ও ভক্তদের বিশ্বাস

দেবশয়নী একাদশীর দিনে সারা দেশের বিষ্ণু মন্দিরগুলিতে বিশেষ পূজা ও ভজন-কীর্তনের আয়োজন করা হয়। ভক্তরা এই দিন উপবাস পালন করেন এবং সারাদিন ভগবান বিষ্ণুর নাম স্মরণ করেন। রাতে জাগরণেরও আয়োজন করা হয়। কিছু ভক্ত বিষ্ণু সহস্রনাম পাঠ করেন।

এই দিনে বিষ্ণু মন্দিরগুলিতে তুলসী, হলুদ ফুল, হলুদ বস্ত্র এবং পঞ্চামৃত দিয়ে বিশেষ পূজা করা হয়। ভক্তরা জলে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে ভগবানকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন। অনেক স্থানে শোভাযাত্রা ও কীর্তন দলগুলির দ্বারা সম্মিলিত ভক্তির আয়োজন করা হয়।

এই বছর ৬ই জুলাই যখন সারা দেশে ভক্তগণ ভগবান বিষ্ণুকে শয়ন করাবেন, তখন পরিবেশ ভক্তিভাবে ভরে উঠবে। মন্ত্রের ধ্বনি, প্রদীপের আলো এবং আস্থার অনুভূতি প্রতিটি ঘরে শুভ শক্তির সঞ্চার করবে।

Leave a comment