আমাদের শরীরের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কান। প্রতিদিন আমরা এর ব্যবহার করছি শোনা ও বোঝার জন্য। কিন্তু কানের ভেতরে জমে থাকা হলুদ বা বাদামি থকথকে ময়লা নিয়ে অনেকেরই দুশ্চিন্তা থাকে। বাইরে থেকে দেখা গেলে তা যেমন অস্বস্তির কারণ হয়, তেমনই অনেক সময় মানুষ এটিকে রোগ বা সংক্রমণ ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, কানের এই ময়লা বা Ear Wax (Cerumen) আদতে একেবারেই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। ENT বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, জোর করে কান খোঁচানো মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
কানের ময়লার আসল কাজ কী?
ENT বিশেষজ্ঞ ডা. মমতা কোঠিওয়ালা জানিয়েছেন, কানের ময়লা আসলে এক ধরনের প্রাকৃতিক সুরক্ষা। কানের বাইরের অংশে যে গ্রন্থি রয়েছে, সেখান থেকেই এটি তৈরি হয়। এর কাজ— বাইরের ধুলোবালি, ছোট পোকা-মাকড় কিংবা জীবাণু যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, তার জন্য এক প্রকার ‘প্রতিরক্ষা প্রাচীর’ গড়ে তোলে এই ময়লা। পাশাপাশি, এটি কানের পর্দাকে সংক্রমণ থেকেও রক্ষা করে। সাধারণত এই ময়লা নিজে থেকেই ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তাই ঘন ঘন কান পরিষ্কার করার কোনও প্রয়োজন নেই।
কখন বিপজ্জনক হতে পারে?
কানের ময়লা জমা স্বাভাবিক হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এটি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমন— অতিরিক্ত ময়লা জমে গিয়ে শুনতে অসুবিধা হওয়া, কান ব্যথা করা, দুর্গন্ধযুক্ত তরল বা রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি। এমন হলে কোনওভাবেই নিজে থেকে তুলো, পিন বা ড্রপ ব্যবহার করা উচিত নয়। অবিলম্বে ENT বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া জরুরি।
তুলো বা হেয়ারপিন দিয়ে কান খোঁচানো কেন মারাত্মক?
অনেকেই অভ্যাসবশত কটন বাড, হেয়ারপিন কিংবা সেফটি পিন ব্যবহার করে কানের ময়লা বের করার চেষ্টা করেন। ডাক্তাররা বলছেন, এতে ময়লা বেরোনোর বদলে উল্টে আরও ভেতরে চলে যায় এবং শক্ত হয়ে আটকে যায়। এর ফলে কানে ব্যথা, ব্লকেজ, সংক্রমণ, এমনকি কানের পর্দায় ফুটো হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ফুটোর আকার বড় হলে শ্রবণশক্তিও কমে যেতে পারে। তাই এই অভ্যাস চরম ক্ষতিকর।
ইয়ার ক্যান্ডলিং কতটা নিরাপদ?
সম্প্রতি বাজারে ইয়ার ক্যান্ডলিং নামক একটি পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। তবে ENT বিশেষজ্ঞরা এটিকে একেবারেই অস্বাস্থ্যকর এবং বিপজ্জনক বলে জানিয়েছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি। বরং উল্টে কানে পোড়া, সংক্রমণ বা স্থায়ী ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাই এই পদ্ধতি থেকে দূরে থাকাই ভালো।
কার কানে বেশি ময়লা জমে?
সব মানুষের ক্ষেত্রে কানের ময়লা জমার হার সমান নয়। কারও কানে খুব দ্রুত ময়লা জমে যায়, তাঁদের বছরে ৩-৪ বার ডাক্তার দিয়ে পরিষ্কার করাতে হয়। আবার অনেকের কানে প্রায় ময়লাই জমে না। তবে স্থায়ীভাবে ময়লা কমানো বা পুরোপুরি বন্ধ করার কোনও উপায় নেই। নিজের থেকে ড্রপ বা ওষুধ ব্যবহার করলে বিপদ বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। অতিরিক্ত ময়লা জমলে কানে চাপ, বাজনা, শুনতে অসুবিধা বা ব্যথা হতে পারে।
কানের সুস্থতার জন্য খাদ্যাভ্যাস
ডাক্তারদের মতে, কানের স্বাস্থ্যও অনেকাংশে নির্ভর করে আমাদের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের উপর। নিয়মিত তাজা ফল ও সবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাছ, আখরোট, ফ্ল্যাক্স সিডস কানের সুস্থতায় সাহায্য করে। অন্যদিকে অতিরিক্ত তেল-মশলা, প্রসেসড ফুড ও জাঙ্কফুড এড়িয়ে চলা উচিত।
কখন অবিলম্বে ডাক্তার দেখাবেন?
হঠাৎ কানে প্রবল ব্যথা, কানে বাজনার মতো শব্দ হওয়া, রক্ত বা হলদে তরল বেরোনো, অথবা পরিষ্কার করার পরও যদি শুনতে সমস্যা হয়— তাহলে অবিলম্বে ENT বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। দেরি করলে সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে।
ENT ডাক্তার কীভাবে পরিষ্কার করেন?
ENT চিকিৎসকরা সাধারণত প্রথমে কানে নরম করার জন্য ড্রপ দেন। যদি তাতেও ময়লা না বেরোয়, তবে নিরাপদভাবে সিরিঞ্জিং বা সাকশনিং পদ্ধতি ব্যবহার করেন। যেহেতু তাঁরা কানের ভেতরের গঠন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত, তাই কোনও ক্ষতি না করেই সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে পারেন।কানের ময়লা কোনও রোগ নয় বরং প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তবে অতিরিক্ত ময়লা জমলে বা অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ENT বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত। নিজে থেকে কান খোঁচানোর অভ্যাস চিরকালীন ক্ষতির কারণ হতে পারে।