টানা বৃষ্টি, জল ছাড়ার জোড়া চাপে বিপর্যস্ত পূর্বস্থলী
গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও একাধিক ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ার ফলে পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২ নম্বর ব্লকের ঝাউডাঙা পঞ্চায়েতে তৈরি হয়েছে জলমগ্ন পরিস্থিতি। চারিদিকে শুধু থৈথৈ জল, মাঠঘাট বলে কিছু আর চেনা যাচ্ছে না। কৃষকদের কপালে শুধুই চিন্তার ভাঁজ— কীভাবে এই অবস্থায় ফসল বাঁচাবেন!
জলের নিচে পাট ক্ষেত, হাহাকার চাষিদের গলায়
সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন পাটচাষিরা। ঝাউডাঙার নিচু জমিগুলি প্রায় সম্পূর্ণ জলে ডুবে গেছে। পাট গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে শুধু, গোড়া কোথায় তা নেই কারও চোখে। পাট কাটার সময় হয়ে এসেছে, কিন্তু জমির এই অবস্থা দেখে অনেকেই বলছেন— এবার পাটের গুণমান নিয়ে বড়সড় ক্ষতি নিশ্চিত।
পাট কাটতে নেই শ্রমিক, নেই ভরসা, নেই রাস্তা
জল জমে যাওয়ায় জমিতে প্রবেশ করাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রমিক সংকট। স্থানীয় বাসিন্দা প্রহ্লাদ ঘোষ বলছেন, “জল বাড়ছে, বাড়ি পর্যন্ত ঢুকে পড়ার আশঙ্কা। পাট কাটা তো দূরের কথা, লোকই মিলছে না কাজে।” সময়মতো পাট না কাটলে, তা রেট্রিং প্রক্রিয়াতেও সমস্যা তৈরি করবে।
গাঁদা ফুলের মাঠ এখন শুধুই ভেসে যাওয়া স্বপ্ন
শুধু পাট নয়, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ফুলচাষিরাও। হালতাচড়া অঞ্চলে গাঁদা ফুলের বিপুল চাষ হয়, যা রাজ্য ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যেও পাঠানো হয়। কিন্তু এখন সেই ফুলের গাছ ডুবে আছে জলেই। অনেকে বলছেন, জল নেমে গেলেও গাছ রোদে শুকিয়ে মারা যাবে। ফলে মনসা, বিশ্বকর্মা ও দুর্গাপুজোর বাজার ধরার স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
সিজনাল চাষ বলে চিন্তা আরও গভীর, মরশুমি রোজগারে বড় ধাক্কা
ফুলচাষিরা জানাচ্ছেন, এই ফুলগুলো কেবল পুজোর মৌসুমকে ঘিরেই চাষ করা হয়েছিল। সহদেব দফাদার, এক অভিজ্ঞ ফুলচাষি বলেন, “এখন যদি জল না নামানো যায়, তাহলে গাছ বাঁচানোই যাবে না। সব শুকিয়ে যাবে। এই মরশুমেই সব কিছু ছিল— বেঁচে থাকার ভরসা।” এমন অবস্থায় বহু কৃষকই ঋণ নিয়েছেন, যা শোধ হবে কবে, কেউ জানে না।
রাস্তা জলে ডুবে, নৌকায় যাতায়াত— যেন জলঘেরা দ্বীপে রূপান্তর গ্রাম
জলমগ্ন হয়েছে ঝাউডাঙা থেকে নদীয়া সংযোগকারী প্রধান রাস্তা। তাই যাতায়াতের একমাত্র ভরসা এখন নৌকা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে স্কুল পড়ুয়া, চাষি, দোকানি— সকলেরই জীবনে এসেছে ভয়ানক ভোগান্তি। দিন যত যাচ্ছে, পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
প্রশাসনের দিকে চেয়ে অসহায় মানুষ, এখনও পর্যন্ত নেই বড় ঘোষণা
এই চরম দুর্দশার মধ্যেও প্রশাসনের তরফে এখনও পর্যন্ত কোনও বড় বা কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। ক্ষতিপূরণ বা জল নামানোর কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা জানানো হয়নি। কৃষিজীবী মানুষজন এখন কার্যত চোখে অন্ধকার দেখছেন।
জীবন ও জীবিকা, দুই-ই তলিয়ে যাচ্ছে একসঙ্গে
পূর্বস্থলীর কৃষিজীবী মানুষদের কাছে বর্ষা মানেই উৎসব, কাজের সময়। কিন্তু এবার তা হয়ে উঠেছে এক দুঃস্বপ্ন। পাটের গন্ধ, ফুলের রঙ— সবই যেন জলের ধারে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। এখন দেখার, প্রশাসন তাঁদের পাশে দাঁড়ায় কি না, নাকি এবারের মতোই তলিয়ে যাবে সব স্বপ্ন।