DNA বিশ্লেষণেই বদলে গেল হিসেব! দেশে হাতির সংখ্যা কমে গেল সাড়ে সাত হাজার

DNA বিশ্লেষণেই বদলে গেল হিসেব! দেশে হাতির সংখ্যা কমে গেল সাড়ে সাত হাজার

জঙ্গলে নীরব হাহাকার: দেরাদুনের ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সর্বশেষ সমীক্ষা জানাল, গত আট বছরে ভারতের জঙ্গলে প্রায় ৭,৪৫০টি হাতি কমে গেছে। ২০১৭ সালের জাতীয় গণনায় যেখানে হাতির সংখ্যা ছিল ২৯,৯৬৪, সেখানে ২০২৫ সালের রিপোর্টে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ২২,৫১৪-এ। অর্থাৎ, দেশের একাধিক অরণ্যে হাতির উপস্থিতি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশের কাছাকাছি।

দক্ষিণবঙ্গে হতবাক পরিসংখ্যান — মাত্র ৩১টি হাতি!

সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য এসেছে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশ থেকে। ২০১৭ সালের সমীক্ষায় জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে ১৯৪টি হাতি থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু নতুন ডিএনএ ভিত্তিক রিপোর্টে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩১।তবে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা বলছে অন্য কথা — তাঁরা প্রায় বছরভরই অনেক বেশি সংখ্যায় হাতি দেখতে পান, বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এই নতুন পরিসংখ্যান কি বাস্তব ছবিকে পুরোপুরি ধরতে পারছে?

উত্তরবঙ্গে উল্টো চিত্র — বেড়েছে হাতির সংখ্যা

দক্ষিণবঙ্গে যেখানে সংখ্যা কমেছে, সেখানে উত্তরবঙ্গে বরং উল্টো ধারা। ২০১৭ সালের তুলনায় এ বার হাতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭৬। আগের গণনায় উত্তরবঙ্গে হাতি ছিল ৪৮৮টি। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোচবিহার থেকে জলদাপাড়া, বানারহাট, গরুমারা — এই অঞ্চলের সংরক্ষিত অরণ্যে হাতিদের চলাফেরা বাড়ছে এবং সীমানা পেরিয়ে আসা ঝাড়খণ্ড ও আসাম সীমান্তের হাতিদেরও এখানে গণনা ধরা পড়েছে।

পুরনো পদ্ধতি ছেড়ে নতুন পথে: ডিএনএ দিয়ে হাতি গণনা

ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এত বছরের ‘সেকেলে’ গণনা পদ্ধতি এবার সম্পূর্ণভাবে বদলে দেওয়া হয়েছে। আগে Total Count Method-এ সমীক্ষকরা যেখানে যেখানে হাতি দেখতেন, সেখানেই সংখ্যা গোনা হতো। ফলে একই হাতি যদি একাধিক রাজ্যের অরণ্যে ঘুরত, তবে তাকে একাধিকবার গোনা হত।কিন্তু এ বার প্রথমবারের মতো DNA বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় ৬.৫ লক্ষ কিলোমিটার জঙ্গল জুড়ে পর্যবেক্ষকরা হাঁটাচলা করে হাতির পায়ের ছাপ ও মলের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। সেই নমুনা থেকে মাইক্রোস্যাটেলাইট ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কোন অঞ্চলে কতগুলি আলাদা হাতির চিহ্ন মিলছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী একই হাতির পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা: দক্ষিণবঙ্গের সংখ্যা আসলে বিভ্রান্তিকর

প্রবীণ গবেষক যুজবেন্দ্র ঝালা ব্যাখ্যা দেন, একটি হাতি একসঙ্গে চারটি রাজ্যের অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে পারে। প্রতিটি রাজ্যের জঙ্গলে তার ডিএনএ পাওয়া গেলেও, সেই হাতি আসলে কোন রাজ্যের বাসিন্দা, তা নির্ধারণ করা কঠিন। আমরা যেখানে তার চলাফেরার ‘বলয়’-এর কেন্দ্রবিন্দু পাই, সেটাকেই তার মূল এলাকা হিসেবে ধরা হয়েছে।এই যুক্তি অনুযায়ী, দক্ষিণবঙ্গের হাতিরা যেহেতু নিয়মিত ঝাড়খণ্ড, ওডিশা ও ছত্তিসগড়ের জঙ্গল থেকে প্রবেশ করে, তাই তাদের চলাচলের কেন্দ্রবিন্দু হয়তো অন্য রাজ্যে পড়েছে। ফলে নতুন পদ্ধতিতে জঙ্গলমহলে হাতির সংখ্যা কম দেখালেও, বাস্তবে তা অনেক বেশি হতে পারে।

কামার কুরেশির দাবি: এবার পরিসংখ্যান অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য

এই সমীক্ষার অন্যতম বিজ্ঞানী ড. কামার কুরেশি জানান, “২০১৭ পর্যন্ত হাতি গণনার যে পদ্ধতি ছিল, তা ছিল অনেকটা আন্দাজের উপর ভিত্তি করে। এবার প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক ডিএনএ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। তাই পরিসংখ্যান কিছুটা চমকপ্রদ মনে হলেও, এটি বাস্তবতার অনেক কাছাকাছি।তিনি আরও বলেন, “এই সমীক্ষা শুধু সংখ্যার হিসেব নয়, বরং হাতির মাইগ্রেশন রুট, জিনগত বৈচিত্র্য ও প্রজনন হার সম্পর্কেও বিশদ তথ্য দিয়েছে। ভবিষ্যতে হাতি সংরক্ষণ নীতিতে এই তথ্যগুলি বড় ভূমিকা নেবে।

হাতি সংরক্ষণে নতুন দিকনির্দেশ: ডিএনএ ডেটাবেস গঠনের পরিকল্পনা

বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রিপোর্ট ভারতের হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পে নতুন মোড় আনবে। এখন পরিকল্পনা চলছে, দেশে সব রাজ্যের হাতির ডিএনএ নমুনা একত্র করে একটি জাতীয় ডিএনএ ডেটাবেস তৈরি করার। এতে ভবিষ্যতে হাতি পাচার, চোরাশিকার বা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রেও সহজে শনাক্ত করা যাবে, কোন অঞ্চলের হাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ডিএনএ সমীক্ষার ফলে যদিও সংখ্যাগতভাবে হাতি কমে যাওয়ার খবর উদ্বেগজনক, তবুও বিশেষজ্ঞরা বলছেন — এই নতুন পদ্ধতি বাস্তব পরিস্থিতির যথার্থ প্রতিফলন দিচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গে ৩১ বলে যা দেখা যাচ্ছে, তা হয়তো প্রকৃত সংখ্যা নয়, বরং নতুন বৈজ্ঞানিক মানদণ্ডে গণনার ফল।

Leave a comment