রাশিয়ার থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখবে ভারত, বহিরাগত চাপের কাছে নতি স্বীকার নয়

রাশিয়ার থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখবে ভারত, বহিরাগত চাপের কাছে নতি স্বীকার নয়

ভারত আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তার জ্বালানি নীতি কোনও বহিরাগত চাপের দ্বারা নয়, বরং তার জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সতর্কতা এবং আমেরিকার শুল্ক আরোপের হুমকি সত্ত্বেও, ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রাখবে। রয়টার্সের নিউজ এজেন্সি অনুসারে, দুজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন যে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে তেলের বেশ কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি রয়েছে, যা অবিলম্বে বাতিল করা সম্ভব নয়।

বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে পরিস্থিতির বিবরণ

গত শুক্রবার, বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়सवाल একটি প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন যে ভারত তেলের বাজারের সহজলভ্যতা, দাম এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা দেখে তেল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি আরও জানান যে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিনের স্থিতিশীল এবং পরীক্ষিত সম্পর্ক রয়েছে, যা তৃতীয় কোনও দেশের মতামত দ্বারা বিচার করা যায় না। মুখপাত্রের মতে, ভারত যে কোনও সিদ্ধান্ত নেয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং তার নিজের স্বার্থ বিবেচনা করে।

ট্রাম্পের তরফে বাগাড়ম্বর তীব্র

ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন যে ভারত শীঘ্রই রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করতে পারে। তিনি এটিকে "ভালো পদক্ষেপ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন, তবে এও স্বীকার করেছেন যে তিনি কেবল শুনেছেন, তিনি এর সত্যতা নিশ্চিত করতে পারবেন না। ট্রাম্প এমন এক সময়ে এই মন্তব্য করেছেন যখন আমেরিকা ভারত সহ অন্যান্য দেশগুলির উপর রাশিয়া থেকে বাণিজ্য করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে।

এর পাশাপাশি, ট্রাম্প জুলাই মাসে এও হুমকি দিয়েছিলেন যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ না হলে রাশিয়া থেকে তেল কেনা দেশগুলির উপর ১০০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের সমালোচনা করে এমনকি এও বলেছিলেন যে ভারত যদি রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্ক বজায় রাখে, তবে তাকে দুর্বল অর্থনীতির ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে পারে।

আমেরিকার আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি

১ আগস্ট থেকে আমেরিকা ভারত থেকে আসা পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপটি ভারতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসাবে দেখা হচ্ছে। ট্রাম্প এর আগেও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে তার উচ্চ শুল্ক নীতির কারণে আমেরিকাকে বাণিজ্য ঘাটতির শিকার হতে হয়। তিনি বলেছিলেন যে ভারতের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য সীমিত, কারণ ভারত অনেক পণ্যের উপর খুব বেশি শুল্ক আরোপ করে।

ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক ও ভোক্তা দেশ। দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং শিল্প প্রয়োজনীয়তার কারণে ভারতকে সস্তা দামে নির্ভরযোগ্য সরবরাহ প্রয়োজন। রাশিয়া এই চাহিদা পূরণের একটি বড় উৎস হয়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ভারত রাশিয়া থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৭.৫ লক্ষ ব্যারেল তেল আমদানি করেছে। এই সংখ্যা গত বছরের তুলনায় সামান্য বেশি।

বর্তমানে রাশিয়া ভারতের বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী, যা দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৩৫ শতাংশ পূরণ করে। এছাড়াও, ইরাক, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলিও ভারতের জন্য প্রধান তেল সরবরাহকারী হিসাবে রয়ে গেছে।

ভারত-রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি ভাঙবে না

সরকারি সূত্র অনুসারে, ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে তেল সরবরাহের যে চুক্তি রয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদী এবং এগুলি একতরফাভাবে বা তাড়াহুড়ো করে বাতিল করা যায় না। এক কর্মকর্তা জানান যে এই চুক্তিগুলি বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা হয়েছে এবং এগুলিতে পরিবর্তন হঠাৎ করে সম্ভব নয়। পাশাপাশি, রাশিয়া ভারতকে ছাড়ের দামে তেল বিক্রি করে, যা ভারতের শক্তি ব্যয়ের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আমেরিকায় বাড়তে থাকা রাজনৈতিক অস্থিরতা

আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা দেশগুলির বিরুদ্ধে কঠোরতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী মার্কো রুবিও সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন যে ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনা আমেরিকা-ভারত সম্পর্কের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। যদিও তিনি এও বলেন যে মিত্র দেশগুলির মধ্যে বিদেশ নীতি নিয়ে মতভেদ হওয়া স্বাভাবিক।

ভারত ও আমেরিকার সম্পর্ক বিগত কয়েক বছরে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হয়েছে, তবে রাশিয়া থেকে ভারতের তেল ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে অনেকবার উত্তেজনাও দেখা গেছে। আমেরিকার বিশ্বাস যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি সমস্ত দেশেরই মেনে চলা উচিত। তবে ভারত সর্বদা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা কোনও আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে না এবং তাদের নীতি তাদের নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে নির্ধারণ করে।

তেলের দাম এবং অফারের উপর থাকবে জোর

ভারতের তেল ক্রয় নীতিতে এটি দেখা হয় যে বিশ্ব বাজারে কোন দেশ থেকে সবচেয়ে ভাল দাম এবং অফার পাওয়া যাচ্ছে। যদি রাশিয়া ভারতকে ছাড়ে তেল সরবরাহ করে এবং তার সরবরাহ অব্যাহত থাকে, তবে ভারত এর জন্য একটি প্রধান সরবরাহকারী হিসাবে থেকে যাবে। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে এই নীতিতে আপাতত কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য এবং বিবৃতি থেকে এটাই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ভারত আপাতত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার মেজাজে নেই। আমেরিকা চাপ সৃষ্টি করুক বা শুল্কের বোঝা বাড়াক, ভারত তার জ্বালানি সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে এবং বাজারের পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে।

Leave a comment