দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক ISRO-NASA-র NISAR স্যাটেলাইট

দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক ISRO-NASA-র NISAR স্যাটেলাইট

৩০শে জুলাই ISRO-NASA NISAR স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। এই উপগ্রহ ভূমিকম্প, সুনামি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে বিপর্যয় মোকাবিলাকে শক্তিশালী করবে।

NISAR: ৩০শে জুলাই ২০২৫ তারিখে ISRO এবং NASA-র যৌথ উপগ্রহ NISAR শ্রীহরিকোটা থেকে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এই উপগ্রহটি পৃথিবীর পৃষ্ঠে হওয়া সামান্য পরিবর্তনগুলিও নজরে রেখে ভূমিকম্প, সুনামি, আগ্নেয়গিরি এবং ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে থেকেই সতর্কবার্তা দেবে। রাশিয়ার কামচাটকায় ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ঠিক ওই দিনেই এই উৎক্ষেপণ হওয়ার কারণে এর প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারতের জন্য এই স্যাটেলাইটটি বিপর্যয় মোকাবিলা, কৃষি এবং জল সম্পদ নিরীক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

শ্রীহরিকোটা থেকে NISAR-এর সফল উৎক্ষেপণ

৩০শে জুলাই ২০২৫ তারিখে ভারতের সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার, শ্রীহরিকোটা থেকে ISRO এবং NASA দ্বারা যৌথভাবে নির্মিত উপগ্রহ NISAR-কে বিকেল ৫:৪০ মিনিটে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এই মিশনটিকে GSLV-F16 রকেটের সাহায্যে সূর্য-সমলয় কক্ষপথে (Sun-Synchronous Orbit) স্থাপন করা হয়েছে। এই প্রথমবার GSLV এই কক্ষপথে কোনো উপগ্রহ পাঠালো।

এই স্যাটেলাইটটির ওজন প্রায় ২,৪০০ থেকে ২,৮০০ কিলোগ্রাম এবং এর আকার একটি SUV গাড়ির মতো। এর ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে এটি সব আবহাওয়ায়, দিন-রাতে, মেঘের মধ্যে থেকেও পৃথিবীর পৃষ্ঠ নিরীক্ষণ করতে পারে।

কামচাটকার ভূমিকম্প দেখিয়ে দিল সতর্কতা সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা

NISAR-এর উৎক্ষেপণের দিনেই রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের কাছে ওখোটস্ক সাগরে ৮.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এই ভূমিকম্পের ফলে জাপান, হাওয়াই, ক্যালিফোর্নিয়া, আলাস্কা, চিলি, পেরু, নিউজিল্যান্ড সহ ১২টি দেশে সুনামির আশঙ্কা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই ভূমিকম্পের শক্তি ৯,০০০ থেকে ১৪,০০০ হিরোশিমা বোমার সমান ছিল।

কুরিল দ্বীপপুঞ্জে ৫ মিটার উঁচু ঢেউ দেখা যায়। জাপানের ফুকুশিমা অঞ্চলের মানুষজন ২০১১ সালের বিধ্বংসী সুনামির স্মৃতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছে যে সময় থাকতে সতর্কবার্তা পেলে বহু মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। NISAR এখন এই কাজটিই করবে।

NISAR কী এবং কীভাবে কাজ করবে?

NISAR-এর পুরো নাম হল – NASA-ISRO Synthetic Aperture Radar। এটি একটি Earth Observation স্যাটেলাইট যাতে দুই ধরনের রাডার লাগানো আছে – L-ব্যান্ড (NASA দ্বারা নির্মিত) এবং S-ব্যান্ড (ISRO দ্বারা নির্মিত)। এগুলোর সাহায্যে এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের ছোট থেকে ছোট পরিবর্তনও রেকর্ড করতে পারবে।

এই উপগ্রহটি পৃথিবীর নির্বাচিত অঞ্চলগুলোর বার বার ছবি তুলবে। এর থেকে এটা জানতে পারা যাবে যে কোনো এলাকার ভূপৃষ্ঠে কোনো অস্বাভাবিক নড়াচড়া বা স্থান পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। এই পরিবর্তনগুলো ভূমিকম্প বা অন্য কোনো দুর্যোগের আগে দেখা যেতে শুরু করে।

ভূমিকম্প ও সুনামির পূর্ব সতর্কতা

NISAR-এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটি ভূমিকম্প এবং সুনামির মতো দুর্যোগের সংকেত সময় থাকতে শনাক্ত করতে পারে। উপগ্রহের নজরদারি ব্যবস্থাটি পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা ফল্ট লাইনগুলির সূক্ষ্ম গতিবিধি ট্র্যাক করবে।

ভূমিকম্পের পরে সমুদ্রের পৃষ্ঠে হওয়া আলোড়ন, জলস্তরের পরিবর্তন এবং ঢেউয়ের প্যাটার্নও এই উপগ্রহ ট্র্যাক করতে পারবে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে সম্ভাব্য সুনামির সতর্কতা আগে থেকেই দেওয়া যেতে পারবে। এই সতর্কতার ভিত্তিতে লোকজনকে সময় থাকতে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

আগ্নেয়গিরি, ভূমিধস এবং বন্যার ওপর নজরদারি

NISAR শুধু ভূমিকম্পই নয়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস এবং বন্যার মতো বিপদগুলোকেও চিহ্নিত করতে সক্ষম। যখন কোনো আগ্নেয়গিরি ফাটতে শুরু করে তখন তার নীচের মাটি ধীরে ধীরে ফুলতে শুরু করে। NISAR সেটা শনাক্ত করতে পারবে।

ভূমিধসের আগে মাটির স্তরগুলো ধীরে ধীরে সরতে থাকে। এই উপগ্রহটি পাহাড়ি এলাকার নিখুঁত ছবি তুলে এই ধরনের সঙ্কেত আগে থেকেই দিতে পারে। একইভাবে নদীর জলস্তর যদি হঠাৎ বাড়তে শুরু করে, তবে সেটি বন্যার সঙ্কেত দেয়। NISAR এটির ওপরও लगातार নজর রাখবে।

ভারতের জন্য এই মিশনের গুরুত্ব

ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। হিমালয় অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা সবসময় থাকে। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল এবং উত্তর-পূর্বে ভূমিধস এবং অসম-কেরলের মতো রাজ্যে বন্যা একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে NISAR-এর মতো উপগ্রহ ভারতের জন্য একটি সুরক্ষা কবচ প্রমাণ হতে পারে।

কৃষি এবং জল ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার

NISAR-এর ব্যবহার শুধুমাত্র দুর্যোগের সতর্কবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই স্যাটেলাইটটি কৃষিক্ষেত্রেও একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এটা ফসলের অবস্থা, মাটির আর্দ্রতা এবং সেচের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করতে পারে। জল ব্যবস্থাপনায়ও এর বড় অবদান থাকতে পারে। এটি ভূগর্ভস্থ জলের স্তর, জলাশয়ের অবস্থা এবং নদীর প্রবাহকে ট্র্যাক করবে। এর ফলে জল সংকট মোকাবিলা করতে এবং উন্নত জল নীতি তৈরি করতে সাহায্য মিলবে।

উপকূলীয় নিরীক্ষণ এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষা

ভারতের একটা বড় অংশ সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। উপকূলীয় ভাঙন, সমুদ্রের ঢেউয়ের শক্তি, সামুদ্রিক বরফ এবং পরিবেশগত পরিবর্তন NISAR-এর নজরে থাকবে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে সময় থাকতে অ্যালার্ট জারি করা এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যকে বাঁচানো সম্ভব হবে।

উৎক্ষেপণে কী কী প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ ছিল

NISAR মিশনটিকে প্রথমে মার্চ ২০২৪-এ উৎক্ষেপণ করার কথা ছিল, কিন্তু প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে সেটি স্থগিত করতে হয়। NASA দ্বারা তৈরি করা L-ব্যান্ড রাডারের অ্যান্টেনায় অতিরিক্ত গরম হওয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এই সমস্যা সফলভাবে সমাধান করার পরে এটিকে ৩০শে জুলাই ২০২৫-এ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।

NISAR মিশনের আরেকটি বড় সুবিধা হল এর ডেটা বিনামূল্যে এবং সকলের জন্য উপলব্ধ থাকবে। বিজ্ঞানী, গবেষক, সরকারি সংস্থা এবং অন্যান্য এজেন্সি এই ডেটা ব্যবহার করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের ওপর আরও ভালোভাবে গবেষণা করতে পারবে।

Leave a comment