কোটা শ্রীনিবাস রাও ছিলেন একজন বহুমুখী এবং মহান অভিনেতা, যিনি ৭৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে খলনায়ক থেকে হাস্যরসাত্মক এবং আবেগপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে সকলের মন জয় করেছিলেন। ব্যাঙ্ক কর্মচারী থেকে চলচ্চিত্রের জগতে তাঁর যাত্রা ছিল অনুপ্রেরণামূলক।
কোটা শ্রীনিবাস রাও: ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ আজ এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারিয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের কিংবদন্তি অভিনেতা এবং ৭৫০টির বেশি ছবিতে খলনায়ক সহ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা কোটা শ্রীনিবাস রাও দীর্ঘ অসুস্থতার পর ৮৩ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। সোমবার সকালে, তাঁর জন্মদিনের দুদিন পর, হায়দ্রাবাদে অবস্থিত জুবিলি হিলসের ফিল্মনগর বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শুধু দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র নয়, গোটা বলিউড শোকস্তব্ধ। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুরাগী এবং চলচ্চিত্র জগতের তারকারা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে চলচ্চিত্রের জগতে যাত্রা
খুব কম লোকই জানেন যে অভিনয়ের জগতে পা রাখার আগে কোটা শ্রীনিবাস রাও একজন ব্যাংক কর্মচারী ছিলেন। তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করার পর স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে চাকরি করতেন। কিন্তু মনের গভীরে কোথাও অভিনয়ের পোকা কিলবিল করত। কলেজ জীবনে তিনি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন এবং মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। এখান থেকেই তাঁর স্বপ্নের দিশা মেলে। তিনি সবসময় তাঁর বাবার মতো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু নিয়তি তাঁকে অভিনয়ের দিকে টেনে আনে। তিনি বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং এর পরে থিয়েটারে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন। এরপর ১৯৭৮ সালে তিনি প্রথম সুযোগ পান ‘প্রণাম খরিদু’ ছবিতে।
প্রত্যেক চরিত্রে প্রাণসঞ্চারকারী শিল্পী
কোটা শ্রীনিবাস রাও তাঁর শক্তিশালী সংলাপ এবং খলনায়কের ভূমিকার জন্য পরিচিত ছিলেন। তবে তিনি কেবল নেতিবাচক চরিত্রে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি হাস্যরসাত্মক, আবেগপূর্ণ এবং সামাজিক চরিত্রগুলিকেও একই নিষ্ঠা ও গুরুত্বের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। চিরঞ্জীবী থেকে শুরু করে আল্লু অর্জুন পর্যন্ত, তিনি প্রতিটি প্রজন্মের সুপারস্টারদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর অভিনয়ের একটি বিশেষত্ব ছিল যে তিনি চরিত্রে পুরোপুরি ডুবে যেতেন। দর্শক তাঁকে দেখে ভয় পেতেন এবং তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করতেন। এই কারণেই তাঁকে দক্ষিণের 'অমরীশ পুরী' বা 'প্রাণ' বলা হতো।
৭৫০টির বেশি ছবিতে অমলিন ছাপ
কোটা শ্রীনিবাস রাও তেলুগু সিনেমার পাশাপাশি তামিল, কন্নড়, মালয়ালম এবং হিন্দি ছবিতেও কাজ করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি ৭৫০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন, যা অত্যন্ত সম্মানজনক একটি সংখ্যা। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে ‘গায়ম’, ‘গায়ম ২’, ‘মনমাডু’, ‘লক্ষ্মী নরসিমা’, ‘আখেরি ওয়ার’ অন্যতম। তাঁর অভিনয়ে এত শক্তি ছিল যে কখনও দর্শক তাঁকে ভয় পেতেন, আবার কখনও তাঁর কথা শুনে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়তেন।
রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
শুধুমাত্র চলচ্চিত্রেই নয়, কোটা শ্রীনিবাস রাও রাজনীতিতেও পা রেখেছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে তিনি বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৯৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়া পূর্ব আসন থেকে বিধায়কও নির্বাচিত হন। তবে তিনি তাঁর অভিনয় জীবনকে রাজনীতির কারণে কখনও পিছিয়ে দেননি।
পুরস্কার ও সম্মানের দীর্ঘ তালিকা
কোটা শ্রীনিবাস রাও তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য অনেক বড় সম্মান পেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করে, যা দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান। এছাড়াও তিনি তেলুগু সিনেমার সবচেয়ে प्रतिष्ठित নন্দী পুরস্কারও নয়বার পেয়েছেন, যা তাঁর প্রতিভা এবং সিনেমায় অবদানের প্রমাণ।
পরিবারেও অভিনয়ের ছাপ
কোটা শ্রীনিবাস রাওয়ের পরিবারেও অভিনয়ের গভীর ছাপ ছিল। তাঁর ছোট ভাই কোটা শঙ্কর রাও-ও ছবিতে অভিনয় করেছেন এবং তাঁর ছেলে কোটা ভেঙ্কট অঞ্জনেয় প্রসাদও বাবার সঙ্গে ‘গায়ম ২’-এর মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন। যদিও, তাঁর ছেলের কয়েক বছর আগে মৃত্যু হয়েছিল।
মৃত্যুর গুজবের প্রতিক্রিয়া
কিছুদিন আগে কোটা শ্রীনিবাস রাওয়ের মৃত্যুর গুজব সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, যা তাঁকে বেশ বিচলিত করেছিল। তিনি নিজেই একটি ভিডিও প্রকাশ করে এই গুজবকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেন এবং বলেছিলেন যে এমন গুজব একজন বৃদ্ধের জীবনও নিতে পারে। তিনি জানান, এর কারণে তাঁর বাড়িতে ১০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল এবং ক্রমাগত ফোন আসছিল। তিনি আরও বলেছিলেন যে, যদি কেউ জনপ্রিয়তা চায়, তবে কঠোর পরিশ্রম করে তা অর্জন করা উচিত, এই ধরনের মিথ্যা কথা ছড়ানো একেবারেই ভুল।
কোটা শ্রীনিবাস রাও – একটি যুগের অবসান
কোটা শ্রীনিবাস রাও তাঁর চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন ১৯৭৮ সালে তেলুগু ছবি ‘প্রণাম খরিদু’ দিয়ে, এর পর তিনি আর পিছন ফিরে তাকাননি। তিনি ধীরে ধীরে দক্ষিণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং জনপ্রিয় খলনায়ক হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু তেলুগুতেই নয়, তামিল, কন্নড়, মালয়ালম এবং হিন্দি ছবিতেও দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তাঁর শক্তিশালী কণ্ঠ, আবেগপূর্ণ অভিব্যক্তি এবং অভিনয়ের গভীরতা তাঁকে সকল ভাষার দর্শকদের কাছে প্রিয় করে তুলেছিল।