মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া জেলায় অবস্থিত ওঙ্কারেশ্বর ধাম, ভগবান শিবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপগুলির মধ্যে গণ্য ১২টি পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। এই মন্দিরটি নর্মদা নদীর মাঝে, মান্ধাতা দ্বীপে অবস্থিত, যা শিবপুরী নামেও পরিচিত। নর্মদা নদীর দুই পাশে ওঙ্কারেশ্বর এবং মামলেশ্বর নামে দুটি মন্দির রয়েছে, যা একত্রে "ওঙ্কারমমলেশ্বর" নামে পরিচিত। এই দুটি স্থান মিলে এই অঞ্চলটি শিবভক্তদের প্রধান তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
আজও জীবিত চৌসারের ঐতিহ্য
শিব-পার্বতীর এই পবিত্র বিশ্রামস্থলে প্রতি রাতে গর্ভগৃহে চৌসার পাতা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, রাতে শিব ও পার্বতী এখানে চৌসার খেলেন এবং বিশ্রাম করেন। এই কারণেই, মন্দিরে এই সময়ে কেউ থাকে না এবং চুপচাপ আরতি করে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভক্তদের জন্য এটি একটি ঐশ্বরিক রহস্য, যা তাদের ওঙ্কারেশ্বরের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে।
শয়ন আরতির রহস্য: যেখানে নির্জনে পূজা হয়
ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের অন্যতম বিশেষ ঐতিহ্য হল রাতের "শয়ন আরতি"। এই আরতির সময় মন্দিরের দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং গর্ভগৃহে শুধুমাত্র একজন পুরোহিত প্রবেশ করেন। ভক্তদের এই আরতি দেখার অনুমতি নেই, এমনকি মন্দিরের কোনো কর্মচারীও এখানে প্রবেশ করতে পারেন না। বিশ্বাস করা হয় যে, এই সময়ে ভগবান শিব ও মাতা পার্বতী মন্দিরে বিশ্রাম করেন এবং তাদের জন্য চৌসার পাতা হয়। সকালে চৌসারের ঘুঁটিগুলো স্থানচ্যুত অবস্থায় পাওয়া যায়, যা ভক্তরা ভগবানের লীলা হিসেবে মনে করেন।
নর্মদা: সেই নদী যা কেবল দর্শনে পুণ্য দেয়
ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের পাশে প্রবাহিত পবিত্র নর্মদা নদীকে স্কন্দ পুরাণে সবচেয়ে পবিত্র নদীগুলির মধ্যে গণনা করা হয়েছে। এটিকে জীবনদাত্রী এবং মোক্ষদাত্রী বলা হয়েছে। বিশেষ বিষয় হল, নর্মদা বিশ্বের একমাত্র নদী, যা পূর্ব থেকে পশ্চিমে নয়, বরং পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এটিকে 'কুমারী নদী'ও বলা হয়। পুরাণ অনুসারে, নর্মদা ভগবান শিবের জটা থেকে উৎপন্ন হয়েছেন এবং তিনি শিবের কন্যা হিসাবেও পরিচিত।
নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গ: যাদের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই
নর্মদা নদীর তীরে পাওয়া কালো পাথরের তৈরি শিবলিঙ্গকে 'নর্মদেশ্বর' বা 'বাণলিঙ্গ' বলা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এই শিবলিঙ্গ স্বয়ম্ভূ এবং তাদের প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয় না। এগুলিকে যে কোনও স্থানে স্থাপন করে পূজা করা যেতে পারে। এই কারণেই নর্মদার তীরে পাওয়া প্রতিটি কঙ্করকে 'শংকর'-এর রূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
গোবিন্দ ভগবৎপাদ গুহা: জ্ঞানের আলো যেখানে জ্বলে উঠেছিল
ওঙ্কারেশ্বরের কাছেই গোবিন্দ ভগবৎপাদ গুহাগুলি অবস্থিত, যা ধর্মীয় এবং দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই গুহাগুলিতেই আদি শংকরাচার্য তাঁর গুরু গোবিন্দ ভগবৎপাদের কাছ থেকে অদ্বৈত বেদান্তের দীক্ষা লাভ করেছিলেন। এটি সেই স্থান যেখানে শঙ্করাচার্য আত্ম-উপলব্ধি লাভ করেন এবং পরে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করে সমগ্র ভারতে বেদান্তের প্রচার করেছিলেন।
গৌরী সোমনাথ মন্দির: বিশাল শিবলিঙ্গের এক अद्भुत উদাহরণ
ওঙ্কারেশ্বরের কাছে অবস্থিত গৌরী সোমনাথ মন্দির একটি প্রাচীন স্থাপত্যের চমৎকার উদাহরণ। এই মন্দিরটি তিনতলা এবং এর গঠন খাজুরাহো মন্দিরগুলির মতো। গর্ভগৃহে অবস্থিত কালো পাথরের তৈরি ছয় ফুট উঁচু শিবলিঙ্গ এখানকার প্রধান আকর্ষণ। এটি ভূমিজ শৈলীতে পরমার বংশ দ্বারা ১১শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল।
সিদ্ধনাথ এবং কেদারেশ্বর মন্দির: আধ্যাত্মিকতা ও স্থাপত্যের ঝলক
এখানে সিদ্ধনাথ মন্দির ব্রাহ্মণকালীন স্থাপত্যের এক अद्भुत নিদর্শন, যার দেওয়াল এবং স্তম্ভগুলিতে সূক্ষ্ম কারুকার্য করা হয়েছে। অন্যদিকে, নর্মদা ও কাভেরি নদীর সঙ্গমে অবস্থিত কেদারেশ্বর মন্দির, উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথের মতো একটি অনুভূতি দেয়।
এখানে প্রতিটি পাথরে শিব বাস করেন
ওঙ্কারেশ্বরের আশেপাশে অন্ধকেশ্বর, ঝুমেশ্বর, নবগ্রহেশ্বর, অবিমুক্তেশ্বর এবং বাটুক ভৈরব-এর মতো আরও অনেক শিব মন্দিরও অবস্থিত। শুধু তাই নয়, এখানে জৈন ধর্মের বিখ্যাত সিদ্ধবরকূট তীর্থস্থানও রয়েছে, যেখানে অনেক প্রাচীন জৈন মন্দির বিদ্যমান। এই সম্পূর্ণ অঞ্চলটিকে শিব ভক্তি এবং আস্থার কেন্দ্র বললে ভুল হবে না।