পি. টি. ঊষা: ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের 'ধাবক রানি' থেকে এক বহুমুখী কিংবদন্তি

পি. টি. ঊষা: ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের 'ধাবক রানি' থেকে এক বহুমুখী কিংবদন্তি

ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের "ধাবক রানি" পি. টি. ঊষা তাঁর কর্মজীবনে এশিয়ান ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অসংখ্য পদক জিতেছেন। অলিম্পিক ও জাতীয় রেকর্ড স্থাপনকারী ঊষা এখন ক্রীড়া প্রশাসন ও রাজনীতিতেও সক্রিয়।

P. T. Usha: পিলাভুল্লাকান্দি ঠেক্কেপারাম্বিল ঊষা, যিনি সাধারণত পি. টি. ঊষা নামে পরিচিত, ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসের এক অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৭ জুন কেরালার কোঠালি, পারাম্বারার কাছে হয়েছিল। ঊষার বেড়ে ওঠা পায়োলিতে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে খেলার প্রতি গভীর আকর্ষণ এবং দ্রুত দৌড়ানোর ক্ষমতা দেখা গিয়েছিল। ১৯৭৯ সাল থেকে ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সে সক্রিয় ঊষা তাঁর প্রতিভার জোরে দেশের নাম আন্তর্জাতিক স্তরে উজ্জ্বল করেছেন।

ঊষাকে ভারতীয় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে "রানি" হিসাবে সম্মানিত করা হয়। তিনি এশিয়ান গেমসে মোট চারটি স্বর্ণ ও সাতটি রৌপ্য পদক অর্জন করেছেন। তাঁর অর্জন এবং খেলার প্রতি নিবেদন তাঁকে কেবল দেশে নয়, এশিয়া এবং বিশ্বজুড়েও সুপরিচিত করেছে।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা 

১৯৭৬ সালে কেরালা রাজ্য সরকার মহিলাদের জন্য ক্রীড়া বিভাগ স্থাপন করে এবং ১৯৭৭ সালে ঊষা কোচ ও. এম. নাম্বিয়ারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। নাম্বিয়ার প্রথমবার ঊষাকে একটি ক্রীড়া পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দেখেন এবং তাঁর দ্রুত চাল ও চটপটে গড়ন দেখে তাঁকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭৮ সালে তিনি জুনিয়র ইন্টার-স্টেট মিটে ছয়টি পদক জেতেন — চারটি স্বর্ণ (১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৬০ মিটার হার্ডলস, হাই জাম্প), একটি রৌপ্য (লং জাম্প) এবং একটি ব্রোঞ্জ (৪ x ১০০ মিটার রিলে)। একই বছর কেরালা রাজ্য কলেজ মিটে তিনি ১৪টি পদক জেতেন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় গেমস এবং ১৯৮০ সালের জাতীয় ইন্টার-স্টেট মিটে তিনি বেশ কয়েকটি রেকর্ড স্থাপন করেন।

তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ছিল ১৯৮০ সালে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত "কায়েদ-এ-আজম" আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতা, যেখানে তিনি চারটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্জন

১৯৮১ সালে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত সিনিয়র ইন্টার-কান্ট্রি মিটে ঊষা ১০০ মিটার (১১.৬ সেকেন্ড) এবং ২০০ মিটার (২৪.৮ সেকেন্ড) দৌড়ে জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেন। ১৯৮২ সালের নয়াদিল্লি এশিয়ান গেমসে তিনি ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটারে রৌপ্য পদক জিতেছিলেন।

১৯৮৩ সালে জামশেদপুরের ওপেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটারে নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করেন। একই বছর কুয়েত সিটি এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ৪০০ মিটারে স্বর্ণপদক জেতেন।

১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক

১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ঊষা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ৪০০ মিটার হার্ডলসে তিনি ৫৬.৮১ সেকেন্ডে হিটস, ৫৫.৯৪ সেকেন্ডে সেমিফাইনাল এবং ৫৫.৪২ সেকেন্ডে ফাইনাল দৌড় শেষ করেন, যেখানে তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। এই পারফরম্যান্স ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

এশিয়ান গেমস এবং চ্যাম্পিয়নশিপে আধিপত্য

১৯৮৫ সালের জাকার্তা এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ঊষা ছয়টি পদক জেতেন — পাঁচটি স্বর্ণ এবং একটি ব্রোঞ্জ। তিনি ১০০ মিটার (১১.৬৪), ২০০ মিটার (২৩.০০৫), ৪০০ মিটার (৫২.৫২) এবং ৪০০ মিটার হার্ডলসে (৫৬.৬৪) চমৎকার পারফরম্যান্স করেন। ১৯৮৬ সালের সিউল এশিয়ান গেমসে তিনি ১০০ মিটারে রৌপ্য এবং ২০০, ৪০০ মিটার ও ৪ x ৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণপদক অর্জন করেন।

পি. টি. ঊষা তাঁর কর্মজীবনের সময় ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এশিয়ান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড মিটে ১৩টি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। ১৯৮৫ সালের জাকার্তা চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর পারফরম্যান্স এশিয়ান গেমসে সর্বোচ্চ স্বর্ণপদক জেতার রেকর্ড হিসেবে নথিভুক্ত আছে।

অবসর এবং ক্রীড়া প্রশাসন

ঊষা ২০০০ সালে তাঁর সক্রিয় ক্রীড়া কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি ভারতীয় ক্রীড়ায় প্রশাসনিক ভূমিকা পালন শুরু করেন। ২০২২ সালে তাঁকে ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (IOA)-এর সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং তিনি এই পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম মহিলা সভাপতি।

রাজনৈতিক কর্মজীবন

ঊষার রাজনৈতিক কর্মজীবনও উল্লেখযোগ্য। ২০২২ সালের জুলাই মাসে তাঁকে ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক রাজ্যসভার মনোনীত সাংসদ করা হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে রাজ্যসভার উপ-সভাপতি প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; তিনিই প্রথম মনোনীত সাংসদ যিনি এই পদটি গ্রহণ করেন। ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজ্যসভার কার্যনির্বাহী অধিবেশনে সভাপতিত্বও করেন।

অবদান ও সামাজিক কাজ

পি. টি. ঊষা বর্তমানে ভারতীয় ট্যালেন্ট অর্গানাইজেশনের কমিটির সভাপতি, যা সারা ভারতের স্কুলগুলিতে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। তিনি খেলাধুলা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন এবং তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার কাজ করেছেন।

ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি

ঊষা সবসময় বলেছেন যে তাঁর উদ্দেশ্য শুধু অলিম্পিয়ান হওয়া ছিল না। তিনি সব সময় নিজেকে তাঁর পুরোনো অর্জন ভেঙে আরও ভালো পারফরম্যান্স করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে প্রতিযোগিতা কেবল নিজের সাথেই হওয়া উচিত, অন্যদের সাথে নয়।

সম্মান ও ঐতিহ্য

ঊষাকে ভারত সরকার এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সম্প্রদায় বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করেছে। তিনি অর্জুন পুরস্কার, পদ্মশ্রী এবং আরও অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন। তাঁর অর্জন ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি এনে দিয়েছে এবং তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।

পি. টি. ঊষার জীবন কেবল খেলাধুলাই নয়, বরং নেতৃত্ব, প্রশাসন এবং সমাজসেবারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি খেলার ক্ষেত্রে ভারতীয় মহিলাদের নতুন পরিচয় এনে দিয়েছেন এবং খেলার প্রতি নিবেদন ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব শিখিয়েছেন। তাঁর অবদান তাঁকে ভারতের গৌরব এবং এশিয়ান গেমসের ধাবক রানি করে তুলেছে।

পি. টি. ঊষার গল্প এটাই বলে যে যদি কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং অধ্যবসায় থাকে, তাহলে যেকোনো চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা যায়। একটি ছোট শহরের মেয়ে থেকে শুরু করে দেশের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের রানি, তারপর ক্রীড়া প্রশাসনের সভাপতি এবং সংসদে উপ-সভাপতি হওয়া পর্যন্ত তাঁর যাত্রা অনুপ্রেরণামূলক। পি. টি. ঊষা কেবল ভারতীয় ক্রীড়া জগতের এক মহান দৌড়বিদই নন, তরুণ প্রজন্মের কাছেও অনুপ্রেরণার উৎস।

Leave a comment