ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে সংবাদপত্র সরবরাহ বন্ধ করলো পাকিস্তান: ভিয়েনা চুক্তি লঙ্ঘন?

ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে সংবাদপত্র সরবরাহ বন্ধ করলো পাকিস্তান: ভিয়েনা চুক্তি লঙ্ঘন?

পাকিস্তান ইসলামাবাদে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে সংবাদপত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত এই পদক্ষেপকে পাকিস্তানের সংকীর্ণ মানসিকতার কাজ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছে।

নয়াদিল্লি: সম্প্রতি পাকিস্তান ইসলামাবাদে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে (Indian High Commission) সংবাদপত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত এই পদক্ষেপকে ভিয়েনা চুক্তির (Vienna Convention) লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে এবং এটিকে "সংকীর্ণ মানসিকতা"র কাজ বলেছে। এই বিতর্ক আবারও এই চুক্তিটিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, যা বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। 

আসুন জেনে নেওয়া যাক ভিয়েনা চুক্তি কী, এর অধীনে কূটনীতিকরা কী কী অধিকার পান এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই বিষয়ে কী চুক্তি হয়েছে।

ভিয়েনা চুক্তি কী?

স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং দূতাবাসগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে একটি সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরি করার জন্য ১৯৬১ সালে Vienna Convention on Diplomatic Relations গ্রহণ করা হয়। এটি জাতিসংঘের অধীনে International Law Commission তৈরি করেছিল। এই চুক্তিটি ১৮ এপ্রিল ১৯৬১ সালে ভিয়েনাতে (অস্ট্রিয়া) স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ২৪ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে কার্যকর হয়। 

২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৯১টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তিতে মোট ৫৪টি অনুচ্ছেদ (Articles) রয়েছে, যা আয়োজক দেশ এবং কূটনৈতিক মিশনের অধিকার ও বাধ্যবাধকতাকে সংজ্ঞায়িত করে।

প্রধান বিধান এবং কূটনীতিকদের অধিকার

ভিয়েনা চুক্তির উদ্দেশ্য হল কূটনীতিকরা যেন কোনো ভয় বা চাপ ছাড়াই তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন তা নিশ্চিত করা। এর অধীনে কূটনীতিকরা নিম্নলিখিত প্রধান অধিকারগুলো পেয়ে থাকেন:

  • গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি (Immunity from Arrest): আয়োজক দেশ কোনো বিদেশি কূটনীতিককে তাদের এলাকায় গ্রেফতার বা আটক করতে পারে না।
  • কাস্টমস ও ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি (Customs & Tax Exemption): কূটনীতিক এবং তাদের পরিবারের ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের উপর শুল্ক (Customs Duty) বা স্থানীয় কর (Local Taxes) আরোপ করা হয় না।
  • দূতাবাসের নিরাপত্তা: আয়োজক দেশ দূতাবাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য। দূতাবাসের চত্বরে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যায় না।
  • কূটনৈতিক যোগাযোগের স্বাধীনতা: কূটনীতিকদের তাদের দেশের সাথে অবাধ যোগাযোগের (Communication) অধিকার রয়েছে, যার মধ্যে কূটনৈতিক ব্যাগ (Diplomatic Bag) এবং বার্তাবাহক (Courier) অন্তর্ভুক্ত।

১৯৬৩ সালের অতিরিক্ত চুক্তি – কনস্যুলার সম্পর্ক

১৯৬১ সালের চুক্তির দুই বছর পর, ১৯৬৩ সালে Vienna Convention on Consular Relations কার্যকর হয়। এই চুক্তি দূতাবাসগুলোর পাশাপাশি কনস্যুলার মিশনের (Consulates) অধিকার এবং কর্তব্যগুলোকেও সংজ্ঞায়িত করে। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো:

  • আর্টিকেল ৩১ – আয়োজক দেশ কনস্যুলার অফিসে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারে না এবং এর নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়।
  • আর্টিকেল ৩৬ – যদি কোনো বিদেশি নাগরিক গ্রেফতার হন, তাহলে আয়োজক দেশকে অবিলম্বে তার দেশের দূতাবাস বা কনস্যুলার মিশনকে এই বিষয়ে জানাতে হবে। এই তথ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নাম, স্থান এবং কারণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

জাতীয় নিরাপত্তা ব্যতিক্রম এবং ভারত-পাকিস্তান চুক্তি

যদিও ভিয়েনা চুক্তি কূটনীতিক অ্যাক্সেসের (Consular Access) অধিকার দেয়, তবে এতে একটি ব্যতিক্রম আছে—জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, যেমন গুপ্তচরবৃত্তি, সন্ত্রাসবাদ বা অন্যান্য গুরুতর অপরাধ, আয়োজক দেশ এই অধিকারকে সীমিত করতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান ২০০৮ সালে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছিল, যার অধীনে উভয় দেশ একে অপরের নাগরিকদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে তথ্য দিতে এবং কূটনৈতিক অ্যাক্সেস দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু এই বিধান জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

পাকিস্তান কর্তৃক ভারতীয় হাইকমিশনে সংবাদপত্র সরবরাহ বন্ধ করার পদক্ষেপকে ভারত ভিয়েনা চুক্তির লঙ্ঘন বলেছে। ভারতের বক্তব্য হল, এটি কূটনীতিকদের তথ্যের অধিকার এবং কাজ করার স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে। কূটনৈতিক প্রোটোকল অনুসারে, আয়োজক দেশকে কেবল কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় না, বরং তাদের দৈনন্দিন কার্যাবলীর জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করতে হয়। সংবাদপত্র সরবরাহ বন্ধ করা, আপাতদৃষ্টিতে ছোট পদক্ষেপ মনে হলেও, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এটি একটি গুরুতর বিষয়।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভিয়েনা চুক্তির গুরুত্ব

ভিয়েনা চুক্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। তা আমেরিকা-রাশিয়ার মধ্যে কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘটনা হোক, বা কোনো ইউরোপীয় দেশে দূতাবাসে হামলা—প্রত্যেকবার এই চুক্তি বিরোধ সমাধানের জন্য আইনি ভিত্তি প্রদান করে। কূটনৈতিকImmunity) এর কারণে মাঝে মাঝে বিতর্কও হয়, বিশেষ করে যখন কোনো কূটনীতিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ওঠে। তবুও, এই চুক্তি আধুনিক কূটনীতির জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ এবং সহযোগিতার ভিত্তি সুরক্ষিত রাখে।

Leave a comment