শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হওয়া রক্ষা বন্ধন কেবল একটি সুতো বাঁধার উৎসব নয়, বরং "স্নেহ ও সংকল্প"-এর এক সনাতন পরম্পরা। বোনেরা ভাইয়ের হাতে রাখী বেঁধে তার দীর্ঘ জীবন ও সুরক্ষার কামনা করে, আর ভাই বোনের সম্মান রক্ষার প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই উৎসবের শিকড় মহাভারত কাল, বিষ্ণু-কৃপা এবং মধ্যযুগীয় ইতিহাস পর্যন্ত বিস্তৃত?
কৃষ্ণ-দ্রৌপদী: করুণা থেকে জন্ম নেওয়া কর্ম-জ্যোতি
মহাভারতের যুদ্ধের কিছু সময় আগে, শ্রীকৃষ্ণ শিশুপাল বধের সময় অস্ত্র চালানোর সময় সামান্য আহত হন। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। সভায় উপস্থিত দ্রৌপদী দেরি না করে নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের আঙুলে বেঁধে দেন। সেই দিনটি ছিল শ্রাবণ পূর্ণিমা। দ্রৌপদীর নিঃস্বার্থ মমতা দেখে অভিভূত কৃষ্ণ কৃতজ্ঞ হয়ে বলেছিলেন, 'সখী! সময় হলে আমি তোমার সম্মান রক্ষা করব।' বহু বছর পর দ্যূত-সভায় যখন দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে উদ্যত হন, তখন কৃষ্ণ সেই 'রক্ষা-বন্ধন'-এর ঋণ পরিশোধ করে অসীম বস্ত্র জুগিয়ে তাঁর মর্যাদা বাঁচান। এই কাহিনী থেকে বার্তা পাওয়া যায় যে, রাখী কেবল রক্ত সম্পর্কের ভাই-বোনের প্রতীক নয়, বরং সেই পবিত্র সম্পর্কেরও প্রতীক যেখানে ত্যাগ ও রক্ষার সংকল্প থাকে।
লক্ষ্মী-মহা বলি: বিষ্ণু-পত্নীর বুদ্ধিতে জন্ম নেওয়া পাতাল-রক্ষা
স্কন্দপুরাণে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে, রাক্ষসরাজ বলি গুরু শুক্রাচার্য্যের সহায়তায় স্বর্গ জয় করেন। বিষ্ণু বামন অবতার ধারণ করে বলির কাছে তিন পা ভূমি দান চান, এবং তৃতীয় পায়ে তাকে পাতালে পাঠান। প্রতিজ্ঞা পালনের কারণে ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং বলির প্রাসাদে দ্বারপাল হয়ে থাকতে শুরু করেন। দেবী লক্ষ্মী তাঁর স্বামীর থেকে আলাদা হওয়ার কারণে চিন্তিত হন। তিনি মানবীর রূপ ধারণ করে শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনে বলিকে হলুদ সুতোর রাখী বাঁধেন এবং "ভাই" মেনে বর চান—'আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও।' প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলি রাখীর সম্মান রেখে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে যাওয়ার অনুমতি দেন। এই কাহিনী বলে যে, রাখী কেবল সুরক্ষা নয়, উৎসর্গ এবং ভক্তির বন্ধনও বটে, যেখানে দেবী স্বয়ং রক্ষা-সূত্র বেঁধে পারিবারিক সুখ অর্জন করেছিলেন।
রানী কর্মবতী-হুমায়ূন: ইতিহাসে মান-মর্যাদার দৃষ্টান্ত
১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে, চিতোরের রানী কর্মবতী মেওয়ারের উপর গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের আক্রমণের আশঙ্কায় ছিলেন। তিনি মোগল সম্রাট হুমায়ূনকে রাখী পাঠিয়ে 'ভাই' সম্বোধন করে সাহায্য চেয়ে পাঠান। এই ইসলামী শাসক রাখীর মর্যাদা উপলব্ধি করেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য নিয়ে চিতোরের দিকে যাত্রা করেন। যদিও যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে দুর্গ বীরগতি ও জওহরের বিভীষিকা সহ্য করে ফেলেছিল, তবুও হুমায়ূন কর্মবতীর আত্ম-সম্মান রক্ষার সংকল্প পূরণ করেন। এই ঘটনাটি দেখায় যে, রক্ষা বন্ধন জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে 'নারী-সম্মান' এবং 'সদ্ভাব'-এর উৎসব।
বর্তমান গুরুত্ব এবং বিধি-বিধান
- পূজা-পূর্ব প্রস্তুতি — ভাই-বোন সকালে স্নানের পর গণেশ এবং কুল-দেবতার আহ্বান করুন।
- রক্ষা-সূত্র — হলুদ বা লাল কাপড়ে হলুদ রোলি, চাল, প্রদীপ এবং মিষ্টি রাখুন। বোন প্রথমে টিপ পরাবে, তারপর চাল দিয়ে রক্ষা-সূত্র বাঁধবে।
- সংকল্প-মন্ত্র — 'যেন বদ্ধো বলি রাজা দানবেন্দ্রো মহাবল:।তেন ত্বাং প্রতিবध्নামী রক্ষে মা চল মা চল॥ '
- ভাইয়ের অঙ্গীকার — শারীরিক উপহারের চেয়ে বোনের স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং সুরক্ষার অঙ্গীকার করাই আসল "নেগ"।
- পরিবেশ-বান্ধব রাখী — বীজ-রাখী বা সুতির সুতো ব্যবহার করুন; পরে এটি মাটিতে পুঁতলে গাছ জন্মায়, যা সম্পর্কের মতো বেড়ে ওঠে।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা
- কর্তব্যপরায়ণতা: কৃষ্ণ-দ্রৌপদী প্রসঙ্গ শিক্ষা দেয় যে, উপকারের প্রতিদান সুযোগ পেলে অবশ্যই দিতে হয়।
- সহ-অস্তিত্ব: লক্ষ্মী-বলি-র কাহিনী ভক্তি ও কর্তব্যের সঙ্গমের দৃষ্টান্ত।
- সাংস্কৃতিক সমন্বয়: রানী কর্মবতী এবং হুমায়ূনের ঘটনা দেখায় যে, একটি সুতো শত্রুদেরও ভাই-বোনের পবিত্র বন্ধনে বাঁধতে পারে।
রক্ষা বন্ধন নিছক একটি উৎসব নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতির 'মূল মন্ত্র'—অন্যের সম্মান ও সুরক্ষার সংকল্প। শ্রীকৃষ্ণের ঋণ-মুক্তির উপকার হোক, দেবী লক্ষ্মীর প্রেমপূর্ণ বিবেচনা হোক বা রানী কর্মবতীর সাহস—প্রতিটি গল্পই বলে যে, রাখী বাঁধার সময় আমরা কেবল সুতো বাঁধি না, বরং বিশ্বাস, সহানুভূতি এবং দায়িত্বকে একসূত্রে গাঁথি। ৯ই আগস্ট শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনে যখন আপনি রাখী বাঁধবেন, তখন এই পৌরাণিক প্রসঙ্গগুলি স্মরণ করুন এবং সংকল্প করুন যে জীবনভর একে অপরের আত্ম-সম্মান রক্ষা করবেন। এটাই রক্ষা বন্ধনের শাশ্বত মহিমা—'সুরক্ষাও, সংস্কারও'।