এসবিআই-এর নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সোনা এখন কেবল অলঙ্কার নয়, বরং অর্থনৈতিক শক্তি এবং কৌশলগত নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। চীন এটিকে জাতীয় নীতির অংশ করেছে, এবং এখন ভারতেরও একটি দীর্ঘমেয়াদী স্বর্ণ নীতি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
এসবিআই রিপোর্ট: ভারতীয় স্টেট ব্যাংক (SBI)-এর নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সোনা এখন শুধু গয়নায় ব্যবহৃত ধাতু বা ঐতিহ্যবাহী বিনিয়োগের বিকল্প নয়। আজ সোনা কোনো দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (Forex Reserves) এবং বৈশ্বিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের এখন একটি দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বর্ণ নীতির প্রয়োজন, যা সোনাকে তার অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত রণনীতিতে দৃঢ়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
চীন এর একটি বড় উদাহরণ। তারা গত দুই দশকে সোনাকে তাদের অর্থনৈতিক পরিচয় এবং বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। এসবিআই বলছে যে ভারতও এখন এই দিকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারে।
সোনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
1930-এর দশকে বিশ্ব গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থা অনুসরণ করত। সেই সময় ডলারের মূল্য নির্ধারণের ভিত্তি ছিল সোনা। 1974 সালে আমেরিকা ডলারকে সোনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর সোনা একটি স্বাধীন সম্পত্তি (Asset) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যা বাজারে বিনিয়োগ এবং নিরাপদ সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
2000 সালের দশকের পর চীন এবং ভারত তাদের স্বর্ণ রিজার্ভ বাড়াতে শুরু করে। ভারত 2009 সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) থেকে প্রায় 6.7 বিলিয়ন ডলার মূল্যের সোনা কেনে এবং তাদের বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণের কৌশলকে শক্তিশালী করে। তারপর থেকে সোনা কেবল একটি আবেগিক ঐতিহ্য নয়, বরং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
ভারতে স্বর্ণ নীতিতে এখন পর্যন্ত কী ঘটেছে
1978 সালের পর অনেক সরকারি কমিটি স্বর্ণ সম্পর্কিত নিয়মাবলী নিয়ে পরামর্শ দিয়েছে। এদের মধ্যে ড. আই.জি. প্যাটেল, ড. সি. রঙ্গরাজন এবং কে.ইউ.বি. রাও প্রধান ছিলেন। তবে এই রিপোর্টগুলিতে সাধারণত এই পরামর্শই দেওয়া হয়েছিল যে মানুষ সোনা জমা করার পরিবর্তে ব্যাংক, বন্ড, ফান্ড ইত্যাদির মতো অন্যান্য বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ করুক।
2015 সালে ভারত সরকার সোনাকে অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প চালু করে।
- গোল্ড মনিটাইজেশন স্কিম (GMS)
- সভরেন গোল্ড বন্ড (SGB)
- ইন্ডিয়ান গোল্ড কয়েন
তবে এসবিআই-এর নতুন রিপোর্ট মনে করে যে এই প্রচেষ্টাগুলি এমন স্তরের নয় যে ভারত বৈশ্বিক স্বর্ণ ব্যবস্থায় চীনের মতো প্রভাব তৈরি করতে পারে। এখন সময় এসেছে একটি সংগঠিত এবং স্থায়ী স্বর্ণ কাঠামো তৈরির।
চীনের রণনীতি থেকে শিক্ষা
চীন সোনাকে কেবল সঞ্চয় বা বিনিয়োগের জিনিস হিসেবেই নয়, বরং তাদের অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা বড় বড় স্বর্ণ ভল্ট তৈরি করেছে, সোনা কেনাবেচার জন্য ট্রেডিং সিস্টেম তৈরি করেছে এবং সোনার মাধ্যমে ডলারের উপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করেছে।

এসবিআই রিপোর্ট বলছে যে ভারতও চাইলে এটি করতে পারে। ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি, জনসংখ্যা এবং অর্থনীতি এতটাই শক্তিশালী যে সোনার মাধ্যমে তারা তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
ভারতে সোনার চাহিদা এবং সরবরাহের ভারসাম্য
2024 সালে ভারতের মোট সোনার চাহিদা ছিল 802.8 টন, যা বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় 26%। অর্থাৎ, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনা ভোক্তা।
কিন্তু ভারতে সোনার খনন খুব কম। তাই ভারতের মোট সোনার ব্যবহারের 86% আমদানি করতে হয়।
2026 আর্থিক বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত প্রায় 26.5 বিলিয়ন ডলারের সোনা আমদানি করেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় 9% কম ছিল। রিপোর্ট বলছে যে ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশে নতুন স্বর্ণ রিজার্ভ পাওয়ার সম্ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভবিষ্যতে আমদানির উপর নির্ভরতা কমতে পারে।
আরবিআই-এর স্বর্ণ কৌশল
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক (RBI)-এর কাছে এখন প্রায় 880 টন সোনা রয়েছে। এটি ভারতের মোট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রায় 15.2% অংশ হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর আগে এই অংশটি মাত্র 9% ছিল।
এখন আরবিআই-এর কৌশল হলো বেশিরভাগ সোনা ভারতের অভ্যন্তরে থাকা সুরক্ষিত ভল্টগুলিতে রাখা। এর উদ্দেশ্য হলো, ভবিষ্যতে যদি কোনো বৈশ্বিক রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তবে দেশের সোনা বাহ্যিক ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত থাকবে।
বিনিয়োগকারীদের সোনার প্রতি প্রত্যাবর্তন
গোল্ড ইটিএফ (Exchange Traded Fund)-এ বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। 2026 আর্থিক বছরের প্রথম ছয় মাসে এতে বিনিয়োগ 2.6 গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বর 2025 পর্যন্ত গোল্ড ইটিএফ-এর মোট মূল্য ₹90,136 কোটি পৌঁছেছে।
একই সাথে, এখন পেনশন ফান্ডেও সোনাকে বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে সোনা এখন আবার একটি নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে।
সভরেন গোল্ড বন্ডে সরকারের ক্ষতি
2015 থেকে 2024 সালের মধ্যে সরকার SGB-এর 67টি কিস্তি জারি করেছে। এর অধীনে 125 টন সোনা বিনিয়োগকারীদের নামে রয়েছে। এখন যেহেতু সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায়, সরকার এই বন্ডগুলিতে প্রায় ₹93,284 কোটি পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অর্থাৎ, সোনার দাম বৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক হলেও, সরকারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সোনার দামের রুপির উপর প্রভাব
এসবিআই রিসার্চ অনুযায়ী, সোনার দাম এবং রুপি (USD/INR)-এর মধ্যে 0.73-এর একটি শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। যখন সোনার দাম বাড়ে, তখন রুপির দুর্বলতা দেখা যায়। রিপোর্ট অনুমান করে যে যদি সোনার দাম প্রতি আউন্স $4000 পর্যন্ত থাকে, তবে ভারতের চলতি হিসাবের ঘাটতির উপর জিডিপি-এর 0.3% প্রভাব পড়তে পারে। তা সত্ত্বেও এসবিআই মনে করে যে FY26-এ চলতি হিসাবের ঘাটতি জিডিপি-এর 1% থেকে 1.1% এর মধ্যে থাকবে, যা একটি নিরাপদ স্তর।












