শ্রীনগরের জবারওয়ান পর্বতে অবস্থিত শঙ্করচার্য মন্দির, প্রাচীন শিবালয় এবং কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই মন্দিরটি ধর্মীয়, ঐতিহাসিক এবং পর্যটন দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে প্রতি বছর মহা শিবরাত্রি এবং হেরাথ উৎসবে ভক্তরা দর্শন করতে আসেন।
শঙ্করচার্য মন্দির: জম্মু ও কাশ্মীরের কাশ্মীর উপত্যকায় অবস্থিত শ্রীনগর তার মনোরম উপত্যকা, হ্রদ এবং ঐতিহাসিক স্থানের জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে জবারওয়ান পর্বতশ্রেণীর চূড়ায় অবস্থিত শঙ্করচার্য মন্দির বা জ্যেষ্ঠেশ্বর মন্দির কাশ্মীরের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রতীক। এই মন্দির ভগবান শিবকে উৎসর্গীকৃত এবং উপত্যকার প্রায় ১,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় এটি কেবল আধ্যাত্মিকই নয়, ভৌগলিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।
মন্দিরে পৌঁছানোর পথটি গাগারিবালের কাছে বুলেভার্ড রোড থেকে শুরু হয়, যা তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের নিরাপদে চূড়া পর্যন্ত নিয়ে যায়। মন্দির থেকে শ্রীনগর শহরের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়, যেখানে ডাল হ্রদ এবং ঝিলাম নদীর প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করা সম্ভব।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
শঙ্করচার্য মন্দির ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রতি বছর মহা শিবরাত্রি এবং হেরাথের মতো উৎসবে প্রচুর সংখ্যক কাশ্মীরি হিন্দু দর্শন ও পূজার জন্য আসেন। মন্দিরের চারপাশের এলাকা ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত এবং এটিকে জাতীয় গুরুত্বের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মন্দিরটির ব্যবস্থাপনা ১৯শ শতাব্দী থেকে একটি দাতব্য ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে কারণ সিং এর সভাপতি ট্রাস্টি। মন্দিরের ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি এটি কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও প্রতীক।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
শঙ্করচার্য মন্দিরকে কাশ্মীরের প্রাচীনতম মন্দির বলে মনে করা হয়। এই মন্দিরটি জবারওয়ান পর্বতশ্রেণীর চূড়ায় অবস্থিত, যা পার্মিয়ান যুগে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপের দ্বারা গঠিত হয়েছিল। মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সঠিক তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, অনেক গবেষণা অনুসারে এই মন্দিরটি ৩৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা গোপাদিত্য দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
কাশ্মীরি ঐতিহাসিক কলহন এটিকে 'গোপাদ্রি' বা 'গোপা পাহাড়' বলেছেন। তার মতে, রাজা গোপাদিত্য এই পাহাড়ের পাদদেশে ব্রাহ্মণদের ভূমি দান করেছিলেন এবং পাহাড়ের চূড়ায় জ্যেষ্ঠেশ্বর শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে আলচোন হুন রাজা মিহিরকুলও মন্দির নির্মাণে অবদান রেখেছিলেন।
১৭শ এবং ১৮শ শতাব্দীতে মন্দিরের পুনর্নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছিল, যা এর বর্তমান কাঠামো তৈরি করেছে। রাজতরঙ্গিনী অনুসারে, মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এবং ঘটনা কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শঙ্করচার্য এবং মন্দিরের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
কাশ্মীরি হিন্দুদের বিশ্বাস যে আদি শঙ্করচার্য এই মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন। এই মন্দির এবং পাহাড়টি তার নামে শঙ্করচার্য পাহাড় নামে পরিচিত হয়। কথিত আছে যে আদি শঙ্করচার্য এই স্থানে শিব ও শক্তির উপাসনাকে একত্রিত করেছিলেন এবং এই অঞ্চলে শক্তিবাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মন্দিরটি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সৌন্দরীলহরী-এর মতো কাব্য রচনা হয়েছিল। মন্দিরের পবিত্রতা এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্ব এটিকে সাধু, যোগী এবং ভক্তদের জন্য একটি বিশেষ কেন্দ্র করে তুলেছে।
স্থাপত্য ও কারুকার্য
শঙ্করচার্য মন্দিরের স্থাপত্য অনন্য এবং জমকালো। এটি একটি কঠিন পাথরের উপর নির্মিত। মন্দিরের ভিত্তি অষ্টভুজাকার, যার প্রতিটি বাহু ১৫ ফুট দীর্ঘ এবং উচ্চতা ২০ ফুট। ভিত্তির উপর অবস্থিত অষ্টভুজাকার কাঠামোটি শীর্ষে একটি বর্গাকার ভবনকে সমর্থন করে।
মন্দিরের কেন্দ্রে ২১.৫ ফুট ব্যাসের একটি গোলাকার কক্ষ রয়েছে, যার প্রবেশদ্বার ৩.৫ ফুট চওড়া। মন্দিরের চারপাশে পাথরের সিঁড়ি রয়েছে, যা ভক্তদের ছাদে নিয়ে যায়। ছাদে চারটি অষ্টভুজাকার স্তম্ভ রয়েছে, যা शिवलिंगের বেসিনকে ঘিরে রেখেছে। মন্দিরের দেয়াল এবং স্তম্ভগুলিতে শৈল্পিক খোদাই এবং ফ্রেস্কো মন্দিরের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যগুলিকে আরও উন্নত করে।
পাহাড়ের ভৌগলিক গুরুত্ব
শঙ্করচার্য পাহাড়, যা সন্ধিমান পর্বত, তখত-এ-সুলেমান বা গোপা হিল নামেও পরিচিত, প্রায় ১,৮৮০ মিটার উঁচু। পাহাড়ের শিলাগুলি আগ্নেয় এবং এটি পার্মিয়ান যুগের আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপের ফল। এখানকার উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং পর্বতারোহণের সম্ভাবনা এটিকে ধর্মীয় তীর্থযাত্রার পাশাপাশি একটি পর্যটন কেন্দ্রও করে তুলেছে।
১৯৬৯ সালে সীমান্ত সড়ক সংস্থা মন্দিরে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তা তৈরি করে, যা তীর্থযাত্রীদের সুবিধা বাড়ায়। রাস্তাটি প্রধানত যোগাযোগ টাওয়ার স্থাপনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, তবে এখন এটি তীর্থযাত্রীদের জন্যও ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক সময় ও পর্যটন
আজ শঙ্করচার্য মন্দির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। মন্দিরে নিয়মিত পূজা হয় এবং অমরনাথ যাত্রার সময় ভক্তরা এটি অবশ্যই দর্শন করেন। মহা শিবরাত্রি এবং হেরাথের মতো অনুষ্ঠানে মন্দিরটি বিশেষভাবে সজ্জিত ও আলোকিত করা হয়।
মন্দিরটি ভারতীয় পর্যটন সার্কিটের অংশ এবং এখানে আসা পর্যটকরা শ্রীনগর এবং এর প্রাকৃতিক দৃশ্যের এক अद्भुत অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ২০২১ সালে, কোভিড-১৯ টিকা অভিযানের সময় মন্দিরটি বিশেষভাবে আলোকিত করা হয়েছিল।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে মন্দির
শঙ্করচার্য মন্দিরের প্রভাব জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও দেখা যায়। বলিউড চলচ্চিত্র যেমন 'মিশন কাশ্মীর' এবং 'পুকার'-এ মন্দিরটি দেখানো হয়েছে। এছাড়াও ১৯৭৪ সালের গান 'জয় জয় শিব শঙ্কর'-এও মন্দিরের উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিকরাও এই মন্দিরের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক নিবন্ধ এবং বইয়ে বর্ণনা করেছেন।
শঙ্করচার্য মন্দির কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মন্দির কেবল ভগবান শিবের উপাসনার কেন্দ্রই নয়, এটি এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেও প্রদর্শন করে, যা ভক্ত ও পর্যটক উভয়কেই আকর্ষণ করে।