মস্কোর রেড স্কোয়ারের আইকনিক স্মৃতিস্তম্ভ, রাশিয়ার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং স্থাপত্য ঐতিহ্যের প্রতীক। এর রঙিন পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজ, বাইজেন্টাইন শৈলী এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য এটিকে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত করে তুলেছে। এই ক্যাথেড্রালটি ধর্মীয় সেবার পাশাপাশি একটি জাদুঘর হিসেবেও কাজ করে।
সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রাল: মস্কোর রেড স্কোয়ারে অবস্থিত সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রাল, রাশিয়ার একটি আইকনিক এবং অনন্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতীক। রাশিয়ান ভাষায় এটি "সোবোর ভাসিলিয়া ব্লাঝেনোগো" নামে পরিচিত এবং এটি মস্কোর অন্যতম বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক। এটি জার ইভান IV 'দ্য টেরিবল'-এর আদেশে ১৫৫৫ থেকে ১৫৬১ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল কাজান ও আস্ট্রাখানের উপর বিজয়কে স্মরণ করা। রঙিন গম্বুজ এবং অনন্য স্থাপত্য শৈলীর কারণে এই ক্যাথেড্রালটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত।
মস্কোর ধর্মীয় স্থান
সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রালের মূল নাম ছিল "ট্রিনিটি চার্চ", যেখানে আটটি চ্যাপেল একটি নবম কেন্দ্রীয় চ্যাপেলের চারপাশে নির্মিত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় চ্যাপেলটি 'মধ্যস্থতা' বা পবিত্র মেরির মধ্যস্থতাকে উৎসর্গীকৃত ছিল। পরে ১৫৮৮ সালে দশম একটি চ্যাপেল নির্মিত হয়, যেখানে স্থানীয় সাধু ভাসিলি (বেসিল)-এর সমাধি অবস্থিত। ১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীতে এই ক্যাথেড্রালটি রাশিয়ার ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত।
বাইজেন্টাইন ঐতিহ্যের অধীনে, গির্জাটি জনপ্রিয়ভাবে "জেরুজালেম" নামেও পরিচিত ছিল। মস্কোর কুলপতি এবং জার-এর উপস্থিতিতে পাম সানডে কুচকাওয়াজের সময় এটি জেরুজালেমের মন্দিরের একটি রূপক হিসেবে বিবেচিত হত।
সেন্ট বেসিল'স-এর রাশিয়ান স্থাপত্য
সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রালের স্থাপত্য অত্যন্ত অনন্য। এখানে নয়টি পেঁয়াজ-আকৃতির গম্বুজ রয়েছে, প্রতিটি একটি পৃথক চ্যাপেলের সাথে যুক্ত। এর কাঠামোটিকে আকাশে উত্থিত একটি শিখার মতো মনে হয়। এটিকে রাশিয়ান জাতীয় স্থাপত্যের চূড়ান্ত রূপ বলে মনে করা হয় এবং এটি রাশিয়ান রেনেসাঁস স্থাপত্যের একটি প্রধান উদাহরণ।
ক্যাথেড্রাল নির্মাণের প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল সেই সময়ের জন্য অভূতপূর্ব ছিল। ভিত্তিটি সাদা পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, যখন গির্জার মূল কাঠামোটি লাল ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এটি মস্কোতে ইট ব্যবহার করা প্রথম ভবনগুলির মধ্যে একটি ছিল। অভ্যন্তরীণ অংশে রয়েছে সরু করিডোর, গম্বুজযুক্ত হল এবং উল্লম্ব সিলিন্ডারের একটি গোলকধাঁধা, যা নয়টি পৃথক চ্যাপেল তৈরি করে। কেন্দ্রীয় চ্যাপেলের ক্ষেত্রফল মাত্র ৬৪ বর্গ মিটার, তবে এটি বিশাল এবং খোলা মনে হয়।
নির্মাণ এবং স্থাপত্য উন্নয়ন
ইভান IV কাজান এবং আস্ট্রাখানের উপর বিজয়ের স্মরণে ১৫৫৪ সালে এই স্থানে কাঠের গির্জা নির্মাণ করেছিলেন। এরপর, ১৫৫৫ সালে, এই স্থানে একটি নতুন পাথরের ক্যাথেড্রাল নির্মাণের আদেশ দেওয়া হয়। গির্জার স্থপতিদের পরিচয় সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট নয়, তবে ঐতিহ্য অনুসারে এটি বার্মা এবং পোস্টনিক ইয়াকভলেভ দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল। কিংবদন্তী অনুসারে, ইভান স্থপতিকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন যাতে সে অন্য কোথাও এমন একটি अद्भुत নির্মাণ করতে না পারে, যদিও ঐতিহাসিকরা এটিকে একটি মিথ বলে মনে করেন।
মূল ট্রিনিটি চার্চ ১৫৮৩ সালে আগুনে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১৫৯৩ সাল পর্যন্ত এটি পুনর্নির্মিত হয়। ১৫৮৮ সালে স্থানীয় সাধু বেসিলের জন্য একটি উপাসনালয় যুক্ত করা হয়েছিল। ১৬৮০-১৬৮৩ সালের মধ্যে ক্যাথেড্রালটি পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং এটিকে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। এই সময়ে, বাইরের বারান্দা এবং খিলানগুলি পুনর্নির্মিত করা হয়েছিল এবং তাঁবু-সদৃশ ছাদগুলি ইট এবং টাইল দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছিল।
রঙ এবং সজ্জা
সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রালের রঙিন চেহারা ১৭শ থেকে ১৯শ শতাব্দীর মধ্যে বিকশিত হয়েছিল। গির্জার গম্বুজগুলিতে সোনার জল, লাল, নীল এবং সবুজ রঙের আধিক্য দেখা যায়। এই রঙের পরিকল্পনা ধর্মীয় প্রতীক এবং বাইবেলের বর্ণনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। কেন্দ্রীয় গম্বুজের চারপাশে আটটি ছোট গম্বুজ এবং অন্যান্য ছোট চ্যাপেলগুলি এর বিশালতা বাড়িয়েছে।
সেন্ট বেসিল'স-এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
সেন্ট বেসিল'স কেবল একটি গির্জা নয়, এটি রাশিয়ার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। এটি সোভিয়েত আমলে জাতীয়করণ করা হয়েছিল এবং ১৯২৮ সাল থেকে এটি রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক জাদুঘরের অংশ হয়ে ওঠে। ১৯২৯ সালে এটিকে সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ করা হয়। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, ১৯৯৭ সাল থেকে এখানে নিয়মিত ধর্মীয় সেবা পুনরায় শুরু করা হয়।
ক্যাথেড্রালের তাৎপর্য কেবল ধর্মীয় নয়। এটি রাশিয়ার জাতীয় পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীকও। মস্কোর রেড স্কোয়ারে এর উপস্থিতি শহরটির স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বকে তুলে ধরে।
সেন্ট বেসিল'স এবং মস্কোর পরিকল্পনা
১৮০০-এর দশকে রেড স্কোয়ারের চারপাশে গির্জা এবং ক্রেমলিনের প্রাচীরের মাঝখানের জায়গা পরিষ্কার করা হয়। সেন্ট বেসিল'স-এর দৃশ্য পরিষ্কার ও স্পষ্ট করার জন্য গির্জা এবং আশেপাশের ভবন ও দোকানপাট সাজানো হয়। ১৮১২ সালে ফরাসি সৈন্যদের দ্বারা মস্কো দখলের সময় গির্জাটিকে আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৯শ এবং ২০শ শতাব্দীতে গির্জার গম্বুজগুলি মেরামত ও পুনর্নবীকরণ করা হয়। ১৯১০ সালে এটি প্রথম গরম বাতাসের হিটিং সিস্টেম পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুনর্নির্মাণ ও পুনর্নবীকরণের সময় মূল ফ্রেস্কো এবং স্থাপত্য উপাদানগুলি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে সর্বশেষ পুনর্নবীকরণের পর ক্যাথেড্রালটি তার পূর্ণ গৌরব ফিরে পায়।
স্থাপত্য শৈলী এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব
সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রালের স্থাপত্য শৈলীতে রাশিয়ান, বাইজেন্টাইন এবং স্থানীয় কাঠের স্থাপত্যের একটি অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এতে এশীয় এবং ইউরোপীয় উপাদানেরও মিশ্রণ রয়েছে। কেন্দ্রীয় চ্যাপেল এবং চারটি বড় চ্যাপেল অষ্টভুজাকার, যখন চারটি ছোট চ্যাপেল ঘনক্ষেত্রাকার।
স্থাপত্যের এই অনন্য শৈলী রাশিয়ায় জাতীয় পুনর্জাগরণের পরিচয় তৈরি করেছে। এর গম্বুজ, খিলান এবং রঙিন টাইলসের সংমিশ্রণ এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার যোগ্য করে তোলে।
ধর্মীয় এবং জাদুঘরীয় ভূমিকা
বর্তমানে সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রালের অর্ধেক অংশ জাদুঘর হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৭ সাল থেকে এখানে সাপ্তাহিক ধর্মীয় উৎসব এবং প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি রবিবার সকালে এখানে সেন্ট বেসিল'স-এর জন্য আκαθιστος এবং ঐশ্বরিক প্রার্থনা সভা হয়। এই ক্যাথেড্রালটি রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের বিশ্বাস এবং মস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।
সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রাল শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি রাশিয়ান স্থাপত্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব প্রতীক। এর নির্মাণ কৌশল, অনন্য নকশা, রঙিন গম্বুজ এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য এটিকে সারা বিশ্বে বিশেষ করে তুলেছে। এটি কেবল মস্কোর রেড স্কোয়ারের শোভা বৃদ্ধি করে না, বরং রাশিয়ার গৌরব ও পরিচয়ের প্রতীকও। সেন্ট বেসিল'স ক্যাথেড্রাল প্রমাণ করে যে স্থাপত্য, শিল্পকলা এবং ইতিহাসের সমন্বয় মানব সভ্যতার অমূল্য অবদানের অংশ হতে পারে।