ভোটার তালিকায় অনিয়মের অভিযোগে অবশেষে কঠোর ব্যবস্থা নিল রাজ্য সরকার। দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চার সরকারি আধিকারিককে সাসপেন্ড করল নবান্ন। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছিল, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে সরাসরি পদক্ষেপ করবে দিল্লি। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিল সরকার।
মুখ্যসচিবের হাতে তদন্তের দায়িত্ব
চার আধিকারিকের বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং চালাবেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। সূত্রের খবর, আপাতত তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও এফআইআর দায়ের করা হয়নি। তবে কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, অভিযুক্তদের প্রশাসনিক পদ থেকে সরানো হয়েছে। ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজে দায়িত্বে থাকা ইআরও ও এইআরও-দের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছিল। কমিশন জানায়, নিয়ম ভেঙে নাম অন্তর্ভুক্ত করা ও বাদ দেওয়ার মতো গুরুতর অনিয়ম তাঁরা করেছেন।
কমিশনের আল্টিমেটাম, দিল্লি ডাক মুখ্যসচিবকে
সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিছুদিন আগে চার আধিকারিককে সাসপেন্ড করার পাশাপাশি এফআইআর দায়েরের নির্দেশ আসে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় সরাসরি মুখ্যসচিবকে দিল্লিতে তলব করে কমিশন। গত ১৩ অগস্ট ওই বৈঠকেই কমিশন কড়া ভাষায় জানিয়ে দেয়, রাজ্যের প্রশাসনিক আধিকারিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ‘অবশ্যই’ করতে হবে। তার পর থেকেই নবান্নে চাপ বাড়তে থাকে।
শেষ সময়সীমার আগে সিদ্ধান্ত
২১ অগস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল মুখ্যসচিবকে। ঠিক ওই দিনই নবান্ন জানায়, চার আধিকারিককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কমিশনের শর্ত আংশিক পূরণ হলেও এফআইআর না করার বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিরোধীরা অভিযোগ করছে, সরকার প্রশাসনিক আধিকারিকদের ‘বাঁচাতে’ চাইছে। তবে কমিশনের কাছে সরকার জানিয়েছে, তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এফআইআর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
কেন এত কড়া কমিশন?
ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (SIR) ঘিরেই মূলত এই পদক্ষেপ। বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই কমিশন বিশেষ উদ্যোগে ভোটার তালিকা পর্যালোচনা শুরু করেছে। প্রাথমিক কাজও ইতিমধ্যেই শেষ। এর মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে অনিয়ম ধরা পড়ায় কমিশন বিশেষভাবে সতর্ক হয়েছে। কমিশনের যুক্তি, ভোটের আগে কারচুপি আটকাতে এই কঠোর ব্যবস্থা জরুরি।
বিরোধীদের প্রশ্ন ও তৃণমূলের আপত্তি
ভোটের অনেক আগে কেন এই পদক্ষেপ, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে রাজ্যের শাসক দল। তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করেছে, কমিশন রাজনৈতিক চাপে রাজ্যের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে। তাঁদের দাবি, ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া, সেখানে এমন হঠাৎ সাসপেনশন কার্যত প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন ঘটাবে। অন্যদিকে বিরোধী শিবির পাল্টা বলছে, কারচুপি আটকাতে এই ব্যবস্থা নেওয়া একেবারেই জরুরি।
রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য
নবান্নের সিদ্ধান্ত ঘিরে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়। বিরোধীরা বলছে, সরকার ‘বাধ্য হয়ে’ পদক্ষেপ করেছে। শাসকদলের তরফে আবার দাবি, কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করেই কাজ এগোচ্ছে। তবে বাস্তবে এই ঘটনা রাজ্য-কমিশন সম্পর্কের নতুন টানাপোড়েন তৈরি করল বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
সামনের দিনেই বাড়তে পারে চাপ
ভোটের আগে কমিশন আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা। রাজ্যের অন্যত্রও যদি একই ধরনের অভিযোগ ওঠে, তবে আরও আধিকারিককে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। ফলে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং একইসঙ্গে রাজনৈতিক চাপ সামলানো।
কমিশন বনাম রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব
এই সাসপেনশন শুধু চার আধিকারিকের ভবিষ্যৎ নয়, রাজনীতি ও প্রশাসনিক সম্পর্কের দিক থেকেও বড় তাৎপর্যপূর্ণ। কমিশনের নির্দেশ অমান্য করলে কীভাবে চাপ তৈরি হতে পারে, তার প্রমাণ মিলল এই ঘটনায়। এখন দেখার, তদন্তে অভিযুক্ত আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ হয় কি না, নাকি এখানেই থেমে যায় বিষয়টি।