ধাতু যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট: ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহের পথে আমেরিকা

ধাতু যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট: ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহের পথে আমেরিকা

চীন ও আমেরিকার মধ্যেকার প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক উত্তেজনা এখন বিরল মৃত্তিকা ধাতুগুলির লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এপ্রিল ২০২৫-এ চীন সাতটি প্রধান বিরল মৃত্তিকা ধাতু রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা মার্কিন টেক এবং অটো কোম্পানিগুলির জন্য একটি ধাক্কা ছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা একটি নতুন পথ বেছে নেয় – ই-বর্জ্য, অর্থাৎ ইলেকট্রনিক বর্জ্য থেকে ধাতু নিষ্কাশনের কৌশল।

আমেরিকা এখন পুরোনো ল্যাপটপ, মোবাইল, টিভি এবং ব্যাটারি থেকে সেই মূল্যবান ধাতুগুলি বের করতে চাইছে, যেগুলির জন্য চীনের উপর তাদের নির্ভরতা এতদিন প্রায় সম্পূর্ণ ছিল।

বিরল মৃত্তিকা ধাতু কী, এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

বিরল মৃত্তিকা ধাতুগুলির ব্যবহার আধুনিক প্রযুক্তিতে হয় – যেমন বৈদ্যুতিক গাড়ি, মোবাইল ফোন, বায়ু টারবাইন, সৌর প্যানেল এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। এর মধ্যে নিওডিমিয়াম, প্রেসিয়োডিমিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম এবং টারবিয়াম-এর মতো উপাদান রয়েছে, যা থেকে চুম্বক এবং বৈদ্যুতিক মোটর তৈরি করা হয়।

এই ধাতুগুলির সরবরাহের প্রায় ৯০ শতাংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে, এবং আমেরিকা এই নির্ভরতা শেষ করার জন্য এখন ই-বর্জ্যকে নতুন উৎস হিসেবে বিবেচনা করছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের বড় অংশীদারিত্ব

সম্প্রতি, আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগ MP Materials-এ একটি বড় অংশীদারিত্ব কিনেছে। এই কোম্পানিটি আমেরিকার একমাত্র সক্রিয় বিরল মৃত্তিকা খনি কোম্পানি, যা ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন পাসে খনন কাজ করছে। তবে খনন থেকে সৃষ্ট পরিবেশগত এবং আইনি বাধার কারণে, আমেরিকা পুনর্ব্যবহারের (রিসাইক্লিং) উপর বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

পুনর্ব্যবহারের গতি বাড়াচ্ছে আমেরিকা

এখন, মার্কিন কোম্পানিগুলি ই-বর্জ্য থেকে সোনা, রুপা, লিথিয়াম, কোবাল্ট এবং বিরল মৃত্তিকা ধাতু নিষ্কাশনের প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গ্লোবাল মেটালস কোম্পানি গ্লেনকোর কানাডায় ১০০ বছরের পুরনো একটি স্মেল্টার সাইট পুনরায় চালু করেছে, যেখানে ১৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত উপাদান থেকে ধাতু নিষ্কাশন করা হচ্ছে।

গ্লেনকোরের রিসাইক্লিং প্রধান, কুনাল সিনহা, সিএনবিসি-কে বলেছেন, "আগে ই-বর্জ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না, কিন্তু এখন এটি অগ্রাধিকারের বিষয়।"

বাড়তে থাকা তামার দাম এবং ট্রাম্পের শুল্ক নীতি

জুলাই ২০২৫-এ, মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তামা আমদানির উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে তামার দামে এবং তা রেকর্ড স্তরে পৌঁছে যায়। আমেরিকা এখনও তার চাহিদার প্রায় অর্ধেক তামা আমদানি করে, তাই এখন কোম্পানিগুলি পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে তামা উত্তোলনের উপর জোর দিচ্ছে।

২০৫০ সাল নাগাদ অনুমান করা হচ্ছে যে আমেরিকার মোট তামার চাহিদার ৪৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমেই পূরণ করা হবে।

ব্যাটারি থেকেও বের হবে নতুন সম্পদ

পুরোনো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি থেকে লিথিয়াম, কোবাল্ট, তামা এবং নিকেল-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাতু বের করা হচ্ছে। এই ধাতুগুলি নতুন ইভি (EV) ব্যাটারি তৈরিতে কাজে লাগে। আমেরিকার বেশ কয়েকটি স্টার্টআপ কোম্পানি, যেমন অ্যাসেন্ড এলিমেন্টস, আমেরিকান ব্যাটারি টেকনোলজি এবং রেডউড ম্যাটেরিয়ালস এই ক্ষেত্রে দ্রুত বিনিয়োগ করছে।

যদিও, ট্রাম্প সরকারের নতুন নীতিতে ট্যাক্স ক্রেডিট নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, যা এই কোম্পানিগুলির পরিকল্পনাগুলির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

ই-বর্জ্যের পাহাড় তৈরি হচ্ছে

ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তি যত দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে, তত দ্রুত ই-বর্জ্যও বেড়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী ৬২ মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেশি ছিল। ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যাটি ৮২ মিলিয়ন টনে পৌঁছতে পারে।

আমেরিকায় ২০২২ সালে ৮ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১৫-২০ শতাংশের সঠিক পদ্ধতিতে পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে।

চীনের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা থেকে ফোর্ড-এর মতো কোম্পানিগুলির উপর প্রভাব

এপ্রিল মাসে চীন যে সাতটি বিরল মৃত্তিকা ধাতুর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তার মধ্যে নিওডিমিয়াম এবং ডিসপ্রোসিয়াম-এর মতো উপাদানগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই উপাদানগুলি ইভি কোম্পানিগুলির জন্য, বিশেষ করে ফোর্ড এবং টেসলার মতো মার্কিন কোম্পানিগুলির জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। জুন মাসে চীন কিছু মার্কিন কোম্পানিকে ছয় মাসের জন্য রপ্তানি লাইসেন্স দিয়েছে, তবে এর শর্তগুলি কঠোর এবং পরিমাণ সীমিত।

ধাতু যুদ্ধের ময়দানে আমেরিকার অস্ত্র বর্জ্য

আমেরিকা ও চীনের মধ্যে চলমান এই অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত টানাপোড়েনে, এখন বর্জ্য অর্থাৎ ই-বর্জ্যকে নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমেরিকার উদ্দেশ্য হল, ই-বর্জ্য থেকে প্রয়োজনীয় ধাতু বের করে চীনের সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করা।

Leave a comment