ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের সাক্ষী: কর্ণাটকের বিরূপাক্ষ মন্দির

ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের সাক্ষী: কর্ণাটকের বিরূপাক্ষ মন্দির

ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে কর্ণাটকের বিরূপাক্ষ মন্দিরের বিশেষ স্থান রয়েছে। এটি কেবল দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্য-ঐশ্বর্যের প্রতীক নয়, বরং এমন একটি মন্দির যা ইতিহাসের বহু উত্থান-পতনের পরেও আজও জীবিত, পূজিত এবং গভীর ভাবে জড়িত একটি তীর্থক্ষেত্র। হাম্পির প্রাচীন রাজধানীতে অবস্থিত এই মন্দিরটি শুধু শিবভক্তদের জন্য নয়, ইতিহাস এবং স্থাপত্যকলায় আগ্রহী সকলের কাছেই আকর্ষণের কেন্দ্র।

প্রাচীনতার স্বাক্ষর: বিরূপাক্ষ মন্দিরের উদ্ভব

বিরূপাক্ষ মন্দিরের ইতিহাস ৭ম শতাব্দীতে শুরু হয়। সেই সময় ভারতে অনেক ছোট-বড় রাজবংশ শাসন করত এবং মন্দির নির্মাণ একটি সাধারণ প্রথা ছিল। প্রথমে এটি একটি ছোট শিবালয় ছিল, কিন্তু ক্ষমতা ও শ্রদ্ধার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি বিশাল চত্বরে পরিণত হয়।

মন্দিরের সূচনা হয়েছিল পম্পা-তীর্থ ক্ষেত্রে বিরূপাক্ষ-পম্পা সম্প্রদায়ের সঙ্গে, যা তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে বহু শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে। ৯ম ও ১০ম শতাব্দীর শিলালিপিতে শিবের পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই প্রমাণগুলি থেকে বোঝা যায় যে, এই স্থানটি অনেক আগে থেকেই ধর্মীয় গুরুত্বের কেন্দ্র ছিল।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে পুনর্গঠন ও বিস্তার

আসল বিস্তার ঘটেছিল ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে, যখন হাম্পি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়। বিশেষ করে রাজা দেব রায় দ্বিতীয়ের আমলে এই মন্দিরটি বিশাল রূপ লাভ করে। তাঁর সেনাপতি লক্কনা দন্ডেশা প্রধান ভবন ও গোপুরম (প্রবেশদ্বার) নির্মাণ করেন। এই সময়েই বিখ্যাত রাজা কৃষ্ণদেবরায় মন্দিরের ভিতরে একটি অলঙ্কৃত সভামণ্ডপ ও প্রবেশদ্বার তৈরি করেন।

১৫১০ খ্রিস্টাব্দে, নিজের রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে কৃষ্ণদেবরায় একটি শিলালিপিও মন্দিরে স্থাপন করেন, যেখানে তাঁর অবদানের বিবরণ রয়েছে। তিনি পূর্ব গোপুরম নির্মাণ করেন, যা আজও মন্দিরের সবচেয়ে উঁচু এবং আকর্ষণীয় অংশ।

স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য: গণিত ও জ্যামিতির অসাধারণ ব্যবহার

বিরূপাক্ষ মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং স্থাপত্যকলার এক চমৎকার উদাহরণ। মন্দিরের প্রধান গোপুরম (প্রবেশদ্বার) নয়তলা এবং প্রায় ৫০ মিটার উঁচু। এর সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য হল—ফრ্যাকটাল জ্যামিতির ব্যবহার। গোপুরমের নকশা উপরে উঠতে উঠতে বারবার পুনরাবৃত্ত হয়, যা এটিকে একটি বরফের ক্রিস্টালের মতো দেখায়।

এই মন্দিরের দেওয়াল, স্তম্ভ এবং ছাদের কারুকার্যেও গাণিতিক নির্ভুলতা দেখা যায়। মন্দিরের গর্ভগৃহ, মণ্ডপ, প্রাঙ্গণ এবংauxiliary মন্দিরগুলির অবস্থানও সম্পূর্ণভাবে পরিকল্পিত এবং সুসংগত।

ধর্ম, ভক্তি ও ধারাবাহিকতা

এমন একটি ঐতিহাসিক ইমারত যা ১৪শ শতাব্দীতেও ছিল, একবিংশ শতাব্দীতেও তেমনই পূজনীয়, বিরূপাক্ষ মন্দিরের এই দিকটিই এটিকে বিশেষ করে তোলে। ১৫৬৫ সালে তালিকোটা যুদ্ধের পর যখন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং অধিকাংশ মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, তখনও বিরূপাক্ষ মন্দির টিকে ছিল। এর কারণ ছিল স্থানীয় মানুষের ভক্তি ও অবিরাম পূজা।

আজও, এই মন্দিরে প্রতিদিন পূজা হয়, বিশেষ অনুষ্ঠানে হাজার হাজার ভক্ত এখানে আসেন। ডিসেম্বর মাসে পম্পা দেবী ও বিরূপাক্ষের বিবাহ উৎসব এবং ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত রথ উৎসব—এই দুটি মন্দিরের প্রধান অনুষ্ঠান।

নদী, প্রকৃতি ও মন্দিরের সম্পর্ক

তুঙ্গভদ্রা নদী এই মন্দিরের জীবনরেখা। মন্দিরের ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদী কেবল ধর্মীয় পবিত্রতাই দেয় না, বরং স্থাপত্যের সঙ্গেও জড়িত। মন্দিরের এক অংশে নদীটি একটি সংকীর্ণ ধারা রূপে প্রবাহিত হয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছায় এবং পরে প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে যায়। এই ব্যবস্থা প্রাচীন জলবিজ্ঞান ও স্থাপত্যের ধারণা প্রকাশ করে।

বিপর্যয় ও সংরক্ষণ

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর অনেক মন্দির লুঠ ও ধ্বংস করা হয়েছিল। বিরূপাক্ষ মন্দিরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু ১৯শ শতাব্দীর শুরুতে কিছু কাঠামোর পুনর্গঠন করা হয়। এর মধ্যে গোপুরমের মেরামত, স্তম্ভগুলির পুনরুদ্ধার এবং অভ্যন্তরীণ মণ্ডপগুলির সংস্কার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বর্তমানে, এটি হাম্পির একমাত্র সক্রিয় মন্দির যেখানে নিয়মিত পূজা হয় এবং যেখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ কাজ চলছে।

হাম্পির ঐতিহ্যে উজ্জ্বল রত্ন

হাম্পির সমস্ত স্মারকগুলির মধ্যে বিরূপাক্ষ মন্দির সবচেয়ে জীবন্ত এবং সচল মন্দির। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে ঘোষিত হাম্পির স্মারকগুলির একটি অংশ। এই মন্দিরটি শুধু ভগবান শিবের প্রতি শ্রদ্ধার কেন্দ্র নয়, বরং বিজয়নগরের শক্তি, শিল্প, বিজ্ঞান এবং ভক্তির প্রতিমূর্তি।

বিরূপাক্ষ মন্দির কেবল একটি উপাসনাস্থল নয়, বরং ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বৈজ্ঞানিক ধারণার জীবন্ত প্রমাণ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিবর্তনশীল সময়, ক্ষমতা, রাজনীতি ও সমাজের পরেও এই মন্দির আজও অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে—এমন একটি স্থান যেখানে ইতিহাস, ভক্তি ও বিজ্ঞানের মিলন ঘটে।

Leave a comment