দক্ষিণবঙ্গের খাল–নালা–বিল জলে টইটম্বুর, উন্নত গ্রেডের পাট ফলনে খুশির হাওয়া গ্রামবাংলায়
বৃষ্টির আশীর্বাদে সোনালি আঁশ, মুখে হাসি রাজ্যের পাটচাষিদেরযখন অতিবৃষ্টির দাপটে রাজ্যের আনাজ চাষ কার্যত ধ্বংসস্তুপে, তখন উল্টো চিত্র পাটক্ষেতে। শুরু থেকেই লাগাতার বর্ষণের ফলে উত্তর থেকে দক্ষিণ—প্রায় সর্বত্রই খাল, বিল, নদী, নালার জলস্তর পূর্ণ। ফলে পাটকাঠি পচানোর কোনও জলের ঘাটতি নেই এ বছর। এমন পরিস্থিতি অনেক দিন দেখা যায়নি। চাষিরাও তাই আশাবাদী, উন্নত মানের কাঁচা পাটের উৎপাদন এ বছর অনেকটাই বেশি হবে।
পাটের আঁশে এবার উজ্জ্বলতা, গ্রেড এক ধাক্কায় দেড় গুণ উন্নত!
সূত্র বলছে, চলতি মরশুমে পাট গাছ যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান এবং জাঁকদার। তাই কাঠি পচানোর পর আঁশ যে আগের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল ও মসৃণ হবে, তা বলাই যায়। কৃষিবিদদের অনুমান, এই বছর কাঁচা পাটের গ্রেড এক থেকে দেড় গুণ পর্যন্ত উন্নত হতে পারে। অর্থাৎ TD-৪ বা ৫ মানের বদলে TD-২ ও ৩-এর মতো উচ্চমানের পাট দেখা যাবে অনেক বেশি।
সারাবছর বৃষ্টির অভাব, এ বছর হল ব্যতিক্রম—ফলে স্বস্তিতে কৃষক
বর্ষা যেন এ বছর চাষিদের আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে পাট চাষে জলাভাব ছিল এক বড় বাধা। খাল–বিলের জলশূন্যতা বা জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকেই পাট পচাতে পারতেন না। কিন্তু এবার বৃষ্টির জলে জমে থাকা প্রাকৃতিক জলাধারই হয়ে উঠছে পাট চাষের আদর্শ ক্ষেত্র। ফলে আঁশও আসবে পরিষ্কার ও মজবুত, যা বাজারে চড়া দামে বিক্রি হবে।
পাট নিগম আশাবাদী, বিঘে প্রতি উৎপাদন ছাড়াবে ৪ কুইন্টাল
জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার (JCI) এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, সাধারণত বিঘে প্রতি যেখানে ৩–৩.৫ কুইন্টাল পাট পাওয়া যায়, সেখানে এবার আশা করা হচ্ছে ৪–৪.৫ কুইন্টাল পর্যন্ত উৎপাদন হবে। তার সঙ্গে থাকবে উন্নত গ্রেডের গ্যারান্টি। এর ফলে চাষিরা শুধুমাত্র বেশি পাট তুলতে পারবেন না, সেই সঙ্গে তুলনামূলক অনেক বেশি দামও পাবেন।
TD-২ পাটে কুইন্টাল পিছু ৬১৫০ টাকা, সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য
যদি কোনও চাষি TD-২ মানের উন্নত পাট ফলাতে পারেন, তবে তিনি সরকারের তরফে প্রতি কুইন্টাল ৬১৫০ টাকা পর্যন্ত সহায়ক মূল্য পাবেন। যা অন্য বছরে TD-৪ বা TD-৫ গ্রেডের ক্ষেত্রে পাওয়া দামের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এই মূল্য চাষিদের মধ্যে ইতিমধ্যেই উৎসাহ জুগিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ হারিয়েছে পাটের ঐতিহ্য, বাংলাদেশ এখনও রমরমিয়ে চাষ করে যাচ্ছে
একসময় পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল বাংলা। ‘গোল্ডেন ফাইবার’ নামে খ্যাত এই ফসল আজ মর্যাদা হারিয়েছে। বিশেষত দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে জলাভাব ও মানহীন বীজের কারণে রুক্ষ, কালচে, নিম্নমানের পাটই বেশি উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে এখনও খাল-বিল-নদী জলের ভান্ডার। ফলে তাদের উৎপাদিত পাট রয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক মানের।
পাট কমিশনের রিপোর্টে সম্ভাবনা—৭৫ লক্ষ বেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা
জুট কমিশনার মলয় চন্দন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, এ বছর রাজ্যে প্রায় ৭৫ লক্ষ বেল কাঁচা পাট উৎপাদন হতে পারে। কয়েক দিনের মধ্যেই চাষিরা কাটা পাট পচানোর কাজ শুরু করবেন বলে আশঙ্কা। বাজারে এর প্রভাব পড়বে আগস্টের শেষ থেকেই।
তবে জলাশয় বুজে যাওয়াই বড় চিন্তা, ব্যক্তিগত পুকুরেও অনুমতি নেই পাট পচানোর
তবে আশঙ্কাও কম নয়। একদিকে যখন বৃষ্টি স্বস্তি দিচ্ছে, অন্যদিকে চাষিরা দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় পড়েছেন মাঠের ধার, রাস্তার পাশে খাল বা নয়নজুলি বুজে যাওয়ার ফলে। অনেক জলাশয়ে মাছচাষ চলছে সমবায়ে—সেখানে পাট পচানোর অনুমতি নেই। আবার ব্যক্তিগত পুকুরেও অনুমতি পাওয়া দুষ্কর।
কম জলে পঁক চাপিয়ে পাট পচালে মান খারাপ হয়, লাভে ক্ষতিই বেশি
যেহেতু পর্যাপ্ত জল থাকে না, তাই অনেক চাষি বাধ্য হন পাটের বান্ডিলের ওপর কাদা মাটি চাপা দিয়ে পচাতে। কিন্তু এতে আঁশে উঠে আসে দাগ, দুর্গন্ধ এবং রং কালচে হয়। যার ফলে বাজারদর কমে যায়। অতএব, এই বছর অতিবৃষ্টি যেনো সেই দীর্ঘদিনের অভাব মেটাতে পারছে। যদি বড় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটে, তবে দক্ষিণবঙ্গের চাষিরা এবার ঘরে তুলতে পারেন উজ্জ্বল, সোনালি, উন্নত মানের কাঁচা পাট।