চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং তিব্বত সফর করে বৌদ্ধ ধর্মকে চীনা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করার বার্তা দিয়েছেন। তিনি জাতিগত ঐক্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং স্থানীয় প্রশাসনিক সংস্কারের ওপরও জোর দিয়েছেন।
Xi Jinping: চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এই মুহূর্তে তিব্বতে রয়েছেন। তাঁর এই সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ তিনি স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টি-র আধিকারিক ও ক্যাডারদের তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মকে চীনা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর স্পষ্ট বার্তা হল, তিব্বতকে আধুনিক সমাজতান্ত্রিক তিব্বত বানানো সরকারের অগ্রাধিকার। এই সফরের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের শক্তি ও প্রভাবকে মজবুত করাও।
শি জিনপিং আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে তিব্বতে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সুনিশ্চিত করা হোক। এর জন্য জাতিগত ঐক্য এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির সমাজের সঙ্গে সহযোগিতা জরুরি। তাঁর বিশ্বাস, স্থিতিশীলতা ও ঐক্য ছাড়া তিব্বতের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
লাসাতে জিনপিং-এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বার্তা
শি জিনপিং-এর যাত্রা লাসা থেকে শুরু হয়েছে, যা তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতম কেন্দ্র। এখানে তিনি শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থানগুলিতে যাননি, বরং এই বার্তাও দিয়েছেন যে চীনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অ্যাজেন্ডা তিব্বতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একত্রিত হবে।
শি জিনপিং আধিকারিকদের বলেছেন যে তাঁরা যেন তিব্বতের শিক্ষা ও প্রশাসনে ম্যান্ডারিন ভাষার ব্যবহারকে উৎসাহিত করেন। তিব্বতের স্থানীয় ভাষা তিব্বতি, কিন্তু চীন চায় যে সরকারি কাজকর্ম ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ম্যান্ডারিন ভাষার প্রাধান্য বাড়ে। এর ফলে চীন তিব্বতের সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে গভীরভাবে পরিবর্তন আনতে পারবে।
তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম ও সমাজতন্ত্রের মিশ্রণ
শি জিনপিং আধিকারিকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে তাঁরা যেন তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মকে চীনা মডেলের সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করেন। তাঁর বিশ্বাস, তিব্বতে ধর্মীয় ও সামাজিক ঐক্য স্থাপন না করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। এর জন্য বিশেষ জেলা তৈরি করা হবে, যেগুলির উদ্দেশ্য হল আলাদা আলাদা জাতির মধ্যে সহযোগিতা তৈরি করা এবং পার্টির নীতিগুলিকে কার্যকর করা।
তিব্বতে জাতিগত ঐক্যকে শক্তিশালী করা
রাষ্ট্রপতি জিনপিং এ-ও বলেছেন যে তিব্বতে জাতিগত ঐক্য ও সামাজিক সংহতি সুনিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এর আওতায় এথনিক ইউনিটি বা জাতিগত ঐক্যকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ জেলাগুলির স্থাপন করা হবে। এই জেলাগুলি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অ্যাজেন্ডা অনুসারে কাজ করবে এবং স্থানীয় লোকেদের সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা স্থাপন করতে সাহায্য করবে।
শি জিনপিং-এর ১২ বছরে দ্বিতীয় সফর
নিজের ১২ বছরের কার্যকালে শি জিনপিং দ্বিতীয়বার তিব্বতে গিয়েছেন। এই সফর এমন এক সময়ে হল যখন চীন দলাই লামার উত্তরসূরিকে মানতে অস্বীকার করেছে। চীনের এই মনোভাব আন্তর্জাতিক স্তরেও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিব্বতের ওপর চীনের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ
তিব্বতের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ ১৯৫০ সাল থেকে শুরু হয়েছে। সেই বছর চীনের সেনা তিব্বতে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে পুরো অঞ্চলের দখল নেয়। ১৯৬৫ সালে তিব্বতকে তিব্বত অটোনমাস রিজন-এর মর্যাদা দেওয়া হয়। তখন থেকে বেজিং ক্রমাগত এই অঞ্চলের ওপর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
দলাই লামা ১৯৫৯ সালে ভারতে এসেছিলেন এবং তখন থেকে ধর্মশালায় থাকছেন। চীন দলাই লামার উত্তরসূরিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে, যার ফলে তিব্বতে চীনের অধিকার আরও মজবুত হবে।
৬০তম বার্ষিকীতে শি জিনপিং-এর সফর
এই বছর তিব্বত অটোনমাস রিজন প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই উপলক্ষ্যেই শি জিনপিং-এর এই সফর। এর আগে ২০২১ সালেও তিনি তিব্বত সফর করেছিলেন। এর আগে ১৯৯০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াং জেমিন তিব্বতে এসেছিলেন। এটা দর্শায় যে তিব্বতে চীনা রাষ্ট্রপতির সফর একটি বিরল ও বিশেষ ঘটনা।
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও মেগা প্রোজেক্ট
তিব্বতের ভৌগোলিক অবস্থান একে এশিয়ার ছাদ বানিয়েছে। চীনের জন্য এই অঞ্চল কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি চীন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর মেগা ড্যাম প্রোজেক্টের ঘোষণা করেছে, যার ফলে তিব্বতের জলসম্পদ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, দলাই লামার উত্তরসূরিকে নিয়ে চীন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে।
প্যাঞ্চেন লামার সঙ্গে সাক্ষাৎ
শি জিনপিং তিব্বতে প্যাঞ্চেন লামার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। প্যাঞ্চেন লামা তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মগুরু। এই সাক্ষাৎকে চীনের ধর্মীয় কৌশল এবং তিব্বতের ওপর নিজেদের অধিকার মজবুত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
লাল গালিচা ও ঐতিহ্যপূর্ণ ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা
লাসাতে পৌঁছনোর পরেই শি জিনপিংকে ঐতিহ্যপূর্ণ ভঙ্গিতে স্বাগত জানানো হয়। স্থানীয় লোকেরা যবের পাত্র তুলে তাঁকে আশীর্বাদ করেন। এটি তিব্বতি ঐতিহ্যের অংশ। শি জিনপিং-ও হাত নেড়ে লোকেদের অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং লাল গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে মূল समारोह স্থলে পৌঁছন।
তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি
তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা সংগঠনগুলি শি জিনপিং-এর সফরের বিরোধিতা করছে। তাঁদের বক্তব্য, চীনের শাসনের অধীনে তিব্বত একটি পুলিশ রাজ্যে পরিণত হয়েছে এবং লোকেদের স্বাধীনতা সীমিত। সংগঠনের প্রতিনিধি নামগ্যাল চোডেপ বলেছেন যে বেজিং-এর দাবি তিব্বতে জনপ্রিয় ও ঐতিহাসিক বৈধতার অভাব দর্শায়।