ঈদ-উল-আযহা, যাকে সাধারণত বকরঈদ বলা হয়, ইসলাম ধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগঘন উৎসব। এই উৎসবটি ত্যাগ, বলিদান এবং ঈশ্বরের প্রতি অটুট সমর্পণের প্রতীক। ২০২৫ সালে এই উৎসবটি ভারত এবং সৌদি আরবে আলাদা আলাদা দিন পালিত হবে। ভারতে ৭ জুন ২০২৫ (শনিবার) বকরঈদ পালিত হবে, অন্যদিকে সৌদি আরবে এই উৎসবটি ৬ জুন ২০২৫ (শুক্রবার) পালিত হবে।
বকরঈদের তারিখ নির্ধারণ: চাঁদ সংক্রান্ত গণনা
ইসলামী ক্যালেন্ডার বা হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী, ঈদ-উল-আযহা ধুল-হিজ্জা মাসের ১০ তারিখে পালিত হয়। যেহেতু হিজরি ক্যালেন্ডার চন্দ্রমার গতির উপর নির্ভরশীল, তাই প্রতি বছর ঈদ-উল-আযহার তারিখ পরিবর্তন হয়। সৌদি আরবে ২৭ মে ২০২৫ সন্ধ্যায় ধুল-হিজ্জার চাঁদ দেখা গিয়েছিল, যার ফলে সেখানে ২৮ মে ইসলামী মাস শুরু হয়েছিল। ফলস্বরূপ, সৌদি আরবে ৬ জুন ঈদ-উল-আযহার দিন নির্ধারিত হয়েছিল।
অন্যদিকে ভারতে ২৮ মে সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর, এখানে ২৯ মে ধুল-হিজ্জার প্রথম তারিখ ধরা হয়েছিল। এই ভিত্তিতে ভারতে ঈদ-উল-আযহা ৭ জুন ২০২৫ পালিত হবে। এক দিনের পার্থক্যের কারণ হল, ভারতে চাঁদ দেখার প্রথা স্থানীয়ভাবে হয়, অন্যদিকে সৌদি আরব এটি কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা করে।
বকরঈদের ইতিহাস এবং ধর্মীয় পটভূমি
বকরঈদের সূত্রপাত একটি ঐতিহাসিক এবং আস্থা-প্রেরণামূলক ঘটনার সাথে জড়িত। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, নবী হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর আদেশে তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইলকে কুরবানি করার সঙ্কল্প নিয়েছিলেন। এটি ছিল ঈশ্বরের আদেশের পরীক্ষা। যখন তিনি তার পুত্রের বলি দেওয়ার চেষ্টা করলেন, আল্লাহ তাঁর সমর্পণে প্রসন্ন হয়ে একটি মেষ পাঠালেন, যার কুরবানি হযরত ইসমাইলের পরিবর্তে দেওয়া হল। সেই থেকে এই দিনটি কুরবানি এবং আল্লাহর প্রতি সমর্পণের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
কুরবানির গুরুত্ব এবং তার সামাজিক বার্তা
বকরঈদের কেন্দ্রীয় উপাদান হল কুরবানি বা বলিদান। এই দিনে মুসলমানরা প্রাণী, সাধারণত ছাগল, ভেড়া, উট বা গরুর কুরবানি দেয়, যা একটি প্রতীকমূলক কাজ। এর উদ্দেশ্য হল দেখানো যে, মানুষ আল্লাহর পথে সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। এই কুরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা হয়:
- প্রথম ভাগ গরিব ও দরিদ্রদের দেওয়া হয়।
- দ্বিতীয় ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
- তৃতীয় ভাগ নিজের জন্য রাখা হয়।
এই প্রথার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিনীতি পালন নয়, বরং সামাজিক সমতা, করুণা এবং সেবা-ভাবের প্রসারও।
হজ্জ যাত্রার সাথে বকরঈদের গভীর সম্পর্ক
ঈদ-উল-আযহার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এটি হজ্জের সমাপ্তির প্রতীক। হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য জীবনে একবার এই তীর্থযাত্রা করা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। হজ্জের শেষ দিন মিনায় মুসলমানরা শয়তানকে পাথর মারার রীতিনীতি পালন করে এবং তারপর প্রাণীর কুরবানি দেওয়া হয়।
ঈদ-উল-আযহার আগেই বাজারে আনন্দ বৃদ্ধি পায়। মানুষ নতুন কাপড় কিনে, মিষ্টি এবং বিশেষ খাবার তৈরি করে। কুরবানির প্রাণীর কেনাকাটা, তাদের দেখভাল এবং সাজানো-গোছানো একটি আলাদা উৎসাহ নিয়ে আসে। এই দিনে সকালে বিশেষ নামাজ আদায় করা হয় এবং তারপর কুরবানি দেওয়া হয়।
বকরঈদ কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও মানবিক বার্তাও দেয়—যে ত্যাগ এবং সেবার কোন বিকল্প নেই। এই উৎসবটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা, স্বার্থ এবং অহংকার ত্যাগ করে অন্যদের সেবা করতে হবে।