শ্রাবণ মাসের গুরুত্ব: ধর্ম, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য রূপ

শ্রাবণ মাসের গুরুত্ব: ধর্ম, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য রূপ

শ্রাবণ মাস, হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, বছরের পঞ্চম মাস। এই মাসটি এবার ১১ই জুলাই, ২০২৫ থেকে শুরু হয়েছে এবং ৯ই আগস্ট, ২০২৫ তারিখে শেষ হবে। এই পুরো মাসটি ভগবান শিবের আরাধনার জন্য উৎসর্গীকৃত। মন্দিরগুলিতে রুদ্রাভিষেক, শিবলিঙ্গে জল নিবেদন এবং কাওাড় যাত্রা-র মতো অনুষ্ঠানগুলি এই সময়ে বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়।

শিব পুরাণে শ্রাবণ মাসের গুরুত্ব বর্ণিত আছে

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, শ্রাবণ মাসে অনেক পৌরাণিক ঘটনা ঘটেছিল। একদিকে যেমন দেবী পার্বতী শিবকে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন, তেমনই সমুদ্র মন্থনের সময় উত্থিত বিষ ভগবান শিব এই মাসেই পান করেছিলেন। এই সময়েই মহাদেবের কণ্ঠ নীল হয়ে যায় এবং তিনি নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত হন।

শিবের পৃথিবীতে আগমন

ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে শ্রাবণ মাসে শিব পৃথিবীতে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে, অর্থাৎ, হিমালয়ে বাস করেন। সেই কারণে, এই পুরো মাসজুড়ে শিবলিঙ্গে জল নিবেদন, বেলপাতা অর্পণ এবং উপবাস পালন শুভ বলে মনে করা হয়। কাওাড়িরা দূর-দূরান্ত থেকে গঙ্গা জল এনে শিবলিঙ্গে অর্পণ করেন।

বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকেও শ্রাবণ মাস গুরুত্বপূর্ণ

শ্রাবণ মাস শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে বর্ষা ঋতু চরম রূপ নেয় এবং আবহাওয়ায় অনেক পরিবর্তন দেখা যায়, যা মানব শরীর, মানসিক অবস্থা এবং প্রকৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে।

হজম ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে ঋতু পরিবর্তন

এই সময়ে পরিবেশে আর্দ্রতা বেশি থাকে, যার ফলে শরীরের হজম প্রক্রিয়া ধীরে হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ভারী খাবার খেলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। আয়ুর্বেদ এবং আধুনিক চিকিৎসা উভয়ই শ্রাবণে হালকা, সহজে হজমযোগ্য এবং কম তেল-মশলার খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়। এই কারণেই এই সময়ে উপবাস ও ফলাহারের প্রথাও বিজ্ঞানসম্মত।

উপবাসের মাধ্যমে পেট শান্ত হয়

শ্রাবণে উপবাস করলে শুধুমাত্র ধর্মীয় লাভ হয় না, এটি শরীরকে ডিটক্স করার একটি স্বাভাবিক উপায়ও। এক বা দুই দিনের উপবাস হজমতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয় এবং শরীরকে ভিতর থেকে পরিষ্কার করে। ফল ও তরল খাবার গ্রহণ করলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টিও পায়।

মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আরামদায়ক মাস

সবুজ-শ্যামল পরিবেশ এবং ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে শ্রাবণ মাস মানসিক শান্তি এনে দেয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলিও এই সত্যতা স্বীকার করে যে প্রকৃতির সান্নিধ্য, সবুজ ঘাস এবং বৃষ্টির ফোঁটা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এই সময়ে মন ভালো থাকে এবং মস্তিষ্ক সতেজ অনুভব করে।

জলাধারগুলির পুনর্ভরণ

শ্রাবণ মাসে নদী, পুকুর, হ্রদ এবং কুয়োর জলের স্তর বাড়ে। এটি প্রাকৃতিক জল সংরক্ষণের সময়। গ্রীষ্মের দীর্ঘ ও শুষ্ক সময়ের পরে শ্রাবণে বৃষ্টি হওয়ায় পৃথিবী নতুন শক্তি পায়। জমিতে আর্দ্রতা আসে এবং কৃষকরা বীজ বপনের জন্য প্রস্তুত হন। এটি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্যও খুবই জরুরি একটি পর্যায়।

পরিবেশে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়

এই সময়ে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি হওয়ার কারণে ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এমন পরিস্থিতিতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে পারে। এই কারণে, ধর্মীয়ভাবে নির্ধারিত উপবাস এবং সীমিত খাদ্য গ্রহণ শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। পূজা-পাঠ, মন্ত্র জপ এবং ধ্যান-এর মতো ক্রিয়াকলাপ মন ও শরীর উভয়কে সক্রিয় রাখে।

গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব এবং শ্রাবণ মাস

জ্যোতিষীদের মতে, শ্রাবণ মাসে গ্রহগুলির অবস্থান এমন থাকে যে এটি সাধনা ও ধ্যানের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে শিব সাধনা পালনকারীদের জন্য এই মাসটি বিশেষ ফলদায়ক। কথিত আছে, এই মাসে করা উপাসনার প্রভাব বহুগুণ বেড়ে যায়।

শ্রাবণের গান ও সাংস্কৃতিক রং

শ্রাবণ মাস কেবল পূজা ও উপবাসের মাস নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গেও জড়িত। এই মাসে লোকগান, দোলনা, হরিয়ালি তীজ এবং মেলার মতো ঐতিহ্য গ্রাম-গঞ্জে দেখা যায়। এই ঐতিহ্যগুলি সামাজিক মেলামেশা বাড়ায় এবং জীবনে রং যোগ করে।

Leave a comment