ভারোত্তোলনে বাংলার নতুন ইতিহাস, বিশ্বরেকর্ড গড়ে আলো ছড়ালেন কোয়েল বর, পাশাপাশি জোড়া সোনা জিতলেন অনিক মুদি
হাওড়ার গর্ব কোয়েল ও অনিক
ভারতের ভারোত্তোলন জগতে আবারও উজ্জ্বল নাম লিখল হাওড়া। কোয়েল বর ও অনিক মুদি, দুই তরুণ প্রতিভা একসঙ্গে নিয়ে এলেন তিনটি সোনার পদক। কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫-এ তাঁদের এই সাফল্য শুধু বাংলার নয়, গোটা দেশের জন্য এক নতুন গর্বের মুহূর্ত।
কোয়েলের বিশ্বরেকর্ডে ইতিহাস
সাব-জুনিয়র ও জুনিয়র ৫৩ কেজি বিভাগে অংশ নিয়ে নজির গড়লেন কোয়েল বর। স্ন্যাচে ৮৫ কেজি এবং ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১০৭ কেজি তুলতে সফল হন তিনি। এতদিন এই বিভাগে ১০৫ কেজিই ছিল রেকর্ড। সেই সীমা ভেঙে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করলেন বাংলার এই মেয়ে। পদক জয় তো আছেই, তার সঙ্গে এই রেকর্ড নতুন এক ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দিল কোয়েলকে।
অনিকের জোড়া শক্তি
অন্যদিকে, সাব-জুনিয়র ৬৫ কেজি বিভাগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান অনিক মুদি। স্ন্যাচে ১০৩ কেজি ও ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১৩৫ কেজি তুলে মোট ২৩৮ কেজি ভার উত্তোলন করেন তিনি। এর ফলে জিতলেন স্বর্ণপদক। হাওড়ার তরুণ অনিকের এই সাফল্যে বাংলার ভারোত্তোলনে আরও এক নতুন তারকার আবির্ভাব ঘটল।
বাংলার নাম বিশ্বমঞ্চে
বাংলার ছেলে-মেয়েরা বরাবরই ক্রীড়াক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। অচিন্ত্য শিউলির পর এবার অনিক ও কোয়েল সেই পথেই হাঁটলেন। তাঁদের সাফল্যে শুধু রাজ্যের নামই নয়, ভারতের ক্রীড়াজগতও আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন করে মর্যাদা পেল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক জয় নতুন প্রজন্মকে ভারোত্তোলনের প্রতি আরও আকৃষ্ট করবে।
প্রশিক্ষকদের উচ্ছ্বাস
অনিকের কোচ তথা বাবা শ্রীকান্ত মুদি জানালেন, ‘‘খেলার প্রতি জেদ আর শৃঙ্খলাই অনিককে এখানে এনেছে।’’ প্রলয় বাগও মত দেন, অনিক অনুশীলনে যে ওজন তোলে, প্রতিযোগিতায় তা পুরোটা প্রদর্শন করতে না পারলেও এই সোনা আরও আত্মবিশ্বাস যোগাবে। কোয়েলের প্রশিক্ষক অষ্টম দাসের কথায়, ‘‘শুধু শারীরিক শক্তি নয়, ভারোত্তোলনে টেকনিক্যাল দক্ষতা থাকা জরুরি। কোয়েল সেটা প্রমাণ করেছে।
প্রতিকূলতার মধ্যেই সাফল্য
তবে এই সাফল্যের পেছনে লুকিয়ে আছে দারুণ সংগ্রামের গল্প। হাওড়ার দেউলপুর গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরের অবস্থা আজও করুণ। বৃষ্টির দিনে অনুশীলন বন্ধ হয়ে যায়, মাথার উপরে শেড নেই, পায়ের নিচে কাঠের মজবুত পাটাতনও নেই। অথচ এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই তৈরি হচ্ছেন কোয়েল-অনিকরা। স্থানীয় প্রশিক্ষকদের আক্ষেপ, অচিন্ত্য শিউলির সাফল্যের পর বহু প্রতিশ্রুতি মিলেছিল, কিন্তু বাস্তবে কাজ হয়নি।
এশিয়ান গেমসের প্রত্যাশা
এই সাফল্যে এখন আশার আলো আরও বেড়েছে। কোচরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক মঞ্চে কোয়েল ও অনিক আরও উজ্জ্বল সাফল্য আনতে পারবেন। বিশেষ করে এশিয়ান গেমস সামনে রেখে তাঁদের থেকে প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। প্রশিক্ষকরা বলছেন, ‘‘যদি সঠিক পরিকাঠামো ও সরকারিভাবে সমর্থন মেলে, তবে বাংলার এই দুই প্রতিভা এশিয়া ও বিশ্বে আরও বড় পদক জেতাতে সক্ষম।
নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা
ভারোত্তোলনে দীর্ঘদিন ধরে যে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছিল, তা ভাঙছে এই সাফল্যে। নতুন প্রজন্ম কোয়েল ও অনিকের পথ অনুসরণ করে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। অচিন্ত্য-শ্রাবণীর মতো নামের পাশে কোয়েল ও অনিক এখন নতুন মাইলফলক। গ্রামের কাঁচা মাটি থেকে উঠে এসে বিশ্বরেকর্ড গড়া যে সম্ভব, তা তাঁরা প্রমাণ করেছেন।
শেষকথা
তিনটি সোনার ঝলক শুধু পদক নয়, বাংলার সংগ্রামী প্রতিভার প্রতিচ্ছবি। দেউলপুর গ্রামের কাদামাটির মাঠ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আসর পর্যন্ত—কোয়েল বর ও অনিক মুদির সাফল্য দেখিয়ে দিল, ইচ্ছাশক্তি থাকলে প্রতিকূল পরিবেশও জয় করা যায়। এখন চোখ এশিয়ান গেমসে। সেখানেও বাংলার এই দুই তারকা দেশের জন্য সোনার হাসি ফোটাতে পারবেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।