আয়ুর্বেদে আদার ব্যবহার
ভারতীয় রান্নাঘরের অন্যতম প্রাচীন মশলা আদা। সর্দি-কাশি, হজমের সমস্যা থেকে শুরু করে গলা ব্যথা সারাতে আদার ব্যবহার বহু যুগ ধরে প্রচলিত। আয়ুর্বেদ ও কবিরাজি চিকিৎসায় আদাকে বলা হয় প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক। চা থেকে তরকারি—সব জায়গাতেই এর ব্যবহার। কিন্তু সবাই জানেন না, এই উপকারী উপাদানই কিছু ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
পুষ্টিবিদ লভনীত বাত্রা জানিয়েছেন, আদা বেশিরভাগ মানুষের জন্য নিরাপদ হলেও কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি খাওয়া মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আলসার, অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি বা পাকস্থলীতে আলগা ক্ষত থাকলে আদা খেলে প্রদাহ বাড়তে পারে। শরীরের ভেতরে ফোঁপড়া তৈরি হয়ে অবস্থা হতে পারে জটিল।
আলসার রোগীদের জন্য বিপজ্জনক
যাঁদের পেটের আলসার রয়েছে, তাঁদের জন্য আদা একেবারেই নিষিদ্ধ। আদার ঝাঁঝালো উপাদান পাকস্থলীতে গিয়ে এসিড নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে আলসারের ক্ষত আরও গভীর হয় এবং ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার জন্ম দেয়। চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলেন, আলসার রোগীরা যদি নিয়মিত আদা খান তবে পাকস্থলীর রক্তপাত পর্যন্ত হতে পারে।
অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি থাকলে সমস্যা
যাঁরা নিয়মিত অম্বল বা অ্যাসিডিটির সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের জন্যও আদা বিপদ ডেকে আনে। আদা খেলে পাকস্থলীতে অ্যাসিডের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়। এতে বুক জ্বালা, পেটে অস্বস্তি ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামান্য পরিমাণ আদা হয়তো সমস্যা করে না, কিন্তু প্রতিদিন অতিরিক্ত খেলে অ্যাসিডিটির সমস্যা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।
রক্তপাতের প্রবণতা বাড়ায়
আদার অন্যতম ক্ষতিকর দিক হলো এটি শরীরের রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। ফলে যাঁদের রক্তপাতের প্রবণতা আছে, তাঁদের জন্য আদা অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন, নাক দিয়ে নিয়মিত রক্ত পড়া, মাসিক কালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা হিমোফিলিয়া রোগীদের জন্য আদা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আদা খাওয়া এই রোগীদের জন্য একেবারেই উচিত নয়।
রক্তচাপ কমে যাওয়ার ঝুঁকি
খুব কম রক্তচাপে ভোগা মানুষের জন্য আদা খাওয়া একেবারেই উচিত নয়। আদা রক্ত সঞ্চালনকে ত্বরান্বিত করে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্লাড প্রেসার আরও কমিয়ে দেয়। এতে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই যাঁরা লো-ব্লাড প্রেসারে ভোগেন, তাঁদের ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া আদা মুখে তোলা ঠিক নয়।
গর্ভবতী মহিলাদের সতর্কতা
গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব দূর করতে অনেক সময় মহিলারা আদা খান। সামান্য পরিমাণ আদা হয়তো ক্ষতিকর নয়, কিন্তু অতিরিক্ত আদা খেলে গর্ভপাত পর্যন্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আদার সক্রিয় উপাদান গর্ভাশয়ের সংকোচন বাড়ায়। ফলে ভ্রূণের ক্ষতি হতে পারে। তাই গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সীমিত পরিমাণে এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে আদা খাওয়া উচিত।
অতিরিক্ত সেবনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
আদা শরীরের জন্য ভেষজ ওষুধ হলেও মাত্রাতিরিক্ত সেবন ভয়ঙ্কর ফল আনতে পারে। অতিরিক্ত আদা খেলে গ্যাস, ডায়রিয়া, বুক ধড়ফড়, অস্বস্তি, পেট মোচড়ের মতো সমস্যা হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিদিন ৩-৪ গ্রাম আদা শরীরের জন্য যথেষ্ট। এর বেশি খাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়।
কারা একেবারেই খাবেন না
ডায়াবেটিস রোগী, হৃৎপিণ্ডের সমস্যায় ভোগা মানুষ, যাঁরা রক্ত তরল রাখার ওষুধ (Blood Thinners) খান, তাঁদেরও আদা থেকে দূরে থাকা উচিত। এই সমস্ত ওষুধের সঙ্গে আদার রাসায়নিক উপাদান মিশে শরীরে অতিরিক্ত ক্ষতি করতে পারে। ফলে যাঁরা নিয়মিত ওষুধ খান, তাঁদের অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে আদা খাওয়া উচিত।
উপকারী হলেও সচেতনতা চাই
আদা যেমন সর্দি-কাশি, হজমের সমস্যা বা প্রদাহ কমাতে দারুণ উপকারী, তেমনি অল্প অসচেতনতা শরীরের বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন— আদাকে ওষুধের মতো ব্যবহার করুন, কিন্তু কখনওই অযথা বেশি পরিমাণে খাবেন না। মনে রাখবেন, প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানই সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করলে উপকারী, কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেলেই তা হয়ে ওঠে বিষ।
শেষকথা
সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বার্তায় চিকিৎসকরা স্পষ্ট জানিয়েছেন— “আদা সবার জন্য নয়।” আলসার, অ্যাসিডিটি, রক্তপাতের ব্যাধি, লো-ব্লাড প্রেসার বা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য আদা মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাই আদার গুণাগুণ যতই থাকুক, সতর্কতা অবলম্বন করাই হবে সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।