শুল্ক এবং বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার সূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ওয়াশিংটন থেকে ভারতে ফিরে এসেছেন। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, এই পর্যায়ের আলোচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সম্পূর্ণ সহমতি তৈরি হয়নি, যে কারণে আলোচনা প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত থাকবে।
ভারত ও আমেরিকার মধ্যে চলমান বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপডেট সামনে এসেছে। অন্তর্বর্তী বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য আমেরিকা যাওয়া ভারতীয় প্রতিনিধি দল এখন দিল্লি ফিরে এসেছে, কিন্তু আলোচনা এখনো অসম্পূর্ণ। খবর অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি প্রধান বিষয়ে সহমতি হয়নি, বিশেষ করে কৃষি এবং অটোমোবাইল-এর মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতভেদ বজায় রয়েছে।
ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজেশ আগরওয়াল। এই দল ২৬ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত আমেরিকার ওয়াশিংটনে ছিল, যেখানে তারা মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখনো অনেক বিষয় বাকি রয়েছে। এরই মধ্যে, আমেরিকা ভারত থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড়ের দাবি জানিয়েছে, যে বিষয়ে ভারত এখনো নমনীয়তা দেখায়নি।
কৃষি এবং অটো সেক্টরে সহমতি হয়নি
সূত্রানুসারে, আমেরিকা চায় যে ভারত কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের পাশাপাশি অটো সেক্টরেও আমদানি শুল্কে ছাড় দিক, কিন্তু ভারত এই দুটি ক্ষেত্রকে "কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল" মনে করে কোনো প্রকার ছাড় দিতে অস্বীকার করেছে।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য, এই সেক্টরগুলিতে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া অভ্যন্তরীণ শিল্পের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই ভারত আপাতত এ বিষয়ে সমঝোতা করতে রাজি নয়।
ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিতের সময়সীমা ৯ জুলাই
এই আলোচনা এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন আমেরিকার দ্বারা আরোপিত পারস্পরিক শুল্ক স্থগিতের সময়সীমা ৯ জুলাই শেষ হচ্ছে। এই কারণেই দুই দেশ ৯ জুলাইয়ের আগে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছে। মার্কিন পক্ষের চাপ রয়েছে যে ভারত শুল্ক কমাক এবং তাদের বাজারকে আরও উন্মুক্ত করুক, বিশেষ করে ইলেকট্রিক গাড়ি, ওয়াইন, পেট্রোকেমিক্যালস এবং কৃষি পণ্যের জন্য।
ভারত ডব্লিউটিও-তে আমেরিকার শুল্কের বিষয়টি তুলেছে
ভারত আমেরিকার শুল্ক নিয়ে তাদের আপত্তি আন্তর্জাতিক স্তরেও জানিয়েছে। ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র সুরক্ষা কমিটিতে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছে যে আমেরিকা ভারত থেকে আসা অটোমোবাইল এবং তাদের যন্ত্রাংশ-এর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।
ভারত ডব্লিউটিও-কে জানিয়েছে যে তারা আমেরিকার এই শুল্ক নীতির জবাবে কিছু মার্কিন পণ্যের উপর পাল্টা শুল্ক আরোপের অধিকার সংরক্ষণ করে। ভারতের এই পদক্ষেপ আমেরিকার শুল্ক নীতির উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির দিকে একটি বড় ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারত আমেরিকা থেকে কি পেতে চায়?
ভারতের পক্ষ থেকেও প্রস্তাবিত চুক্তিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি রাখা হয়েছে। ভারত চায় আমেরিকা বস্ত্র, চামড়া, রত্ন-অলঙ্কার, তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, রাসায়নিক দ্রব্য, চিংড়ি, তৈলবীজ, আঙুর এবং কলার মতো পণ্যের উপর শুল্ক ছাড় দিক। এই সেক্টরগুলির সঙ্গে যুক্ত শিল্পগুলি ভারতের রপ্তানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আমেরিকার বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য ভারত এগুলির উপর শুল্ক ছাড় চায়।
আমেরিকার কি কি দাবি ভারতের কাছে
অন্যদিকে, আমেরিকার দাবিগুলিও দীর্ঘ। আমেরিকা চায় যে ভারত কৃষি পণ্য, যেমন আপেল, বাদাম, জিনগতভাবে পরিবর্তিত শস্য, ওয়াইন, অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক গাড়ি এবং কিছু প্রযুক্তি-ভিত্তিক পণ্যের উপর শুল্ক কমাক। এছাড়াও দুগ্ধজাত পণ্য নিয়েও আমেরিকা ক্রমাগত ভারতের কাছে ছাড় চাইছে।
যদিও ভারতের পক্ষ থেকে দুগ্ধ সেক্টরে আপাতত কোনো ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, এই সেক্টর গ্রামীণ কর্মসংস্থান এবং খাদ্য সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত, যেটিকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ভারতীয় দলের কঠোর অবস্থান
ওয়াশিংটন থেকে ভারতীয় দলের ফিরে আসার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ভারত, আমেরিকার চাপে পড়ে কোনো তাড়াহুড়ো করে সমঝোতা করতে চাইছে না। কয়েক দিন আগে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন যে ভারত খুব বড় শুল্ক হ্রাস করতে চলেছে এবং আমেরিকার জন্য বাজার খুলতে চলেছে। এর পরে খবর এসেছিল যে ভারত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চুক্তি করতে পারে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে স্পষ্ট যে ভারত এই বিষয়গুলিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং মার্কিন দাবিগুলি সম্পূর্ণভাবে মানতে অস্বীকার করেছে।
ছোট চুক্তির (Mini Deal) সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সব বিষয়ে সহমতি না হয়, তাহলে ভারত ও আমেরিকা একটি ‘ছোট বাণিজ্য চুক্তি’-র (Mini Trade Deal) কথা বিবেচনা করতে পারে। এই ধরনের চুক্তিতে দুই দেশ সেই ক্ষেত্রগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করবে যেগুলিতে সহমতি হয়েছে, যেখানে বিতর্কিত ক্ষেত্রগুলিকে আপাতত চুক্তি থেকে বাইরে রাখা হবে।
এর ফলে উভয় দেশকে এই বার্তা দিতে সাহায্য করবে যে বাণিজ্য আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে, যদিও সম্পূর্ণ চুক্তি সম্পন্ন হতে আরও কিছু সময় লাগতে পারে।