রাম বিলাস পাসোয়ানের জন্মবার্ষিকী: সামাজিক ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

রাম বিলাস পাসোয়ানের জন্মবার্ষিকী: সামাজিক ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

লোক জনশক্তি পার্টি (LJP)-র প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতীয় রাজনীতির অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে গণ্য হওয়া রাম বিলাস পাসওয়ানের আজ জন্মবার্ষিকী, যিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের রাজনীতির এক শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত। ৫ই জুলাই, ১৯৪৬ সালে বিহারের খাগড়িয়া জেলার শহরবন্নি গ্রামে এক দলিত পরিবারে জন্ম নেওয়া পাসোয়ান, প্রতিকূলতা পেরিয়ে শুধু রাজ্যেই নয়, জাতীয় স্তরেও নিজের শক্তিশালী পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর জীবন কেবল রাজনীতিই নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচারের লড়াই এবং বঞ্চিতদের কণ্ঠস্বরকে বুলন্দ করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল।

ডিএসপির চাকরি ছেড়ে রাজনৈতিক পথ বেছে নেওয়া

রাম বিলাস পাসোয়ান পড়াশোনায় শুরু থেকেই মেধাবী ছিলেন। তিনি কোসি কলেজ, খাগড়িয়া এবং পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষ করার পর, ১৯৬৯ সালে তিনি বিহার পুলিশ সার্ভিসে ডিএসপির পদে নির্বাচিত হন। সেই সময়, একজন দলিত যুবকের জন্য এই পদ একটি বিশাল সাফল্যের চেয়ে কম কিছু ছিল না। কিন্তু পাসোয়ানের স্বপ্ন শুধু একটি নিরাপদ চাকরি করা ছিল না – বরং তিনি পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। সমাজসেবার আবেগ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তাঁকে রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে আসে। তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং সেই বছরই সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখেন।

রাজনীতির সূচনা এবং গিনেস বুকে নাম

রাম বিলাস পাসোয়ান তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা ১৯৬৯ সালে যুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে শুরু করেন এবং সেই বছরই আলওলি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। তবে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি আসল পরিচিতি পান ১৯৭৭ সালে, যখন তিনি হাজিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জনতা পার্টির টিকিটে নির্বাচন লড়ে রেকর্ড ৪.২৫ লক্ষ ভোটে জয়লাভ করেন। এই জয় সেই সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে পাওয়া জয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল এবং তাঁর নাম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এ নথিভুক্ত হয়।

আশ্চর্যজনক বিষয় হল, তিনি ১৯৮৯ সালে আবারও হাজিপুর থেকে নির্বাচনে জিতে নিজের রেকর্ড ভেঙে দেন। এটি প্রমাণ করে যে জনগণের মধ্যে তাঁর সমর্থন কতটা শক্তিশালী ছিল এবং তিনি কতটা জনপ্রিয় নেতা ছিলেন।

এলজেপির ভিত্তি এবং ছয় জন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ

২০০০ সালে রাম বিলাস পাসোয়ান লোক জনশক্তি পার্টি (LJP) প্রতিষ্ঠা করেন। এই পার্টি শুরু থেকেই দলিত, পিছিয়ে পড়া এবং বঞ্চিত শ্রেণির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। পাসোয়ান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নয়বার লোকসভা এবং দুবার রাজ্যসভার প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি ছিল—ক্ষমতায় টিকে থাকা। তিনি ছয় জন প্রধানমন্ত্রী—ভি.পি. সিং, এইচ.ডি. দেবগৌড়া, আই.কে. গুজরাল, অটল বিহারী বাজপেয়ী, ড. মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদী—এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি রেল, কয়লা, টেলিযোগাযোগ এবং গ্রাহক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলি সামলেছেন। এটি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং ভারসাম্যের কৌশলেরই ফল ছিল যে তিনি সব সময়ে ক্ষমতাসীন শিবিরে নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।

‘আবহাওয়াবিদ’ এবং ব্যক্তিগত জীবনের আলোচনা

রাম বিলাস পাসোয়ানকে ‘আবহাওয়াবিদ’ বলা হতো, কারণ তিনি সময়ের আগেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে এবং সঠিক পক্ষ বেছে নিতে পারদর্শী ছিলেন। কংগ্রেস সরকার হোক বা বিজেপি, তিনি সবসময় নিজেকে প্রাসঙ্গিক রেখেছিলেন।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও আলোচনায় ছিল। তিনি ১৯৬০ সালে রাজকুমারী দেবীকে বিবাহ করেন, কিন্তু এই সম্পর্ক ১৯৮১ সালে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে শেষ হয়। এরপরে তিনি ১৯৮৩ সালে রীনা শর্মাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন, যিনি এয়ার ইন্ডিয়ায় একজন বিমান সেবিকা ছিলেন।

চিরাগ পাসোয়ান উত্তরাধিকার বহন করছেন

রাম বিলাস পাসোয়ানের মৃত্যু হয় ৮ই অক্টোবর ২০২০ সালে, দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের লড়াই আজও দেশের মানুষের মনে জীবিত। তাঁর চিন্তা ও আদর্শ শুধু তাঁর দলকেই নয়, সমগ্র দলিত রাজনীতিকে দিশা দেখায়। তাঁর ছেলে চিরাগ পাসোয়ান এখন এলজেপির দায়িত্ব নিয়ে পিতার উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং সামাজিক উদ্বেগকে কেন্দ্রে রেখে দলকে নতুন দিশা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

রাম বিলাস পাসোয়ান আজ আমাদের মধ্যে না থাকলেও, ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর অবদান, বিশেষ করে দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির অধিকারের জন্য তাঁর লড়াই, তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে। তাঁর জীবন তাঁদের জন্য অনুপ্রেরণা, যাঁরা সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও বড় স্বপ্ন দেখেন এবং তা পূরণ করার জন্য সংগ্রাম করেন।

Leave a comment