বিপদসীমা ছোঁয়নি জলাধার তবু কেন এই জলছাড়া আবার বিতর্কে DVC রাজ্যের প্রশ্ন ‘কার স্বার্থে

বিপদসীমা ছোঁয়নি জলাধার তবু কেন এই জলছাড়া আবার বিতর্কে DVC রাজ্যের প্রশ্ন ‘কার স্বার্থে

বর্ষার মাঝপথেই মাইথন ও পাঞ্চেত থেকে বিপুল জল ছেড়েছে ডিভিসি। অথচ জলাধারের স্তর এখনও অনেকটা নিচে। প্রশ্ন উঠছে—জলাধারে জল না রেখেই কেন এমন তৎপরতা? কী বলছে রাজ্য? কী জবাব ডিভিসির? জেনে নিন পুরোটাই।

জলাধারে এখনও আছে জায়গা, তবু কেন হঠাৎ ৩৫ হাজার কিউসেক ছাড়ল DVC?

বুধবার আচমকাই মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে ডিভিসি ছেড়ে দিল প্রায় ৩৫ হাজার কিউসেক জল। মাইথন থেকে ছাড়া হল ৬ হাজার, আর পাঞ্চেত থেকে ২৯ হাজার কিউসেক জল। অথচ জলাধারে জল ছিল বিপদসীমা ছুঁয়ে যাওয়ার বহু আগেই। মাইথনে জল স্তর ছিল ৪৬৬.৩১ ফুট এবং পাঞ্চেতে ৪০৩.৩৩ ফুট। এই পরিস্থিতিতে এত পরিমাণ জলছাড় ডিভিসির আচরণ নিয়েই উঠেছে বড় প্রশ্ন।

বিপদসীমা কত, আর কতটা জল রাখা যেত—প্রাক্তন আধিকারিকই জানালেন ফাঁস তথ্য

ডিভিসির প্রাক্তন এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর আঞ্জনি দুবে জানালেন, বর্ষার মরশুমে মাইথনে ৪৮০–৮৫ ফুট পর্যন্ত এবং পাঞ্চেতে ৪১৫–১৬ ফুট জল রাখা যায়। তা হলে, প্রশ্ন উঠছেই—৪৬৬ ও ৪০৩ ফুটে পৌঁছনোর আগেই এত জল ছাড়ার প্রয়োজন কেন? তাঁর মন্তব্য, এই জল ছাড়ার কারণে ভবিষ্যতে শিল্পাঞ্চলে জলের সংকট দেখা দিতে পারে। বোরো চাষ থেকে শিল্পে, পানীয় জলের উৎসে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকছেই।

গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ জলছাড়া, তখন পরিস্থিতি ছিল আরও জটিল!

২০২৪ সালের ২৩ জুলাই দুই বাঁধ থেকে মাত্র ১৮ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছিল। অথচ এবার ৩৫ হাজার কিউসেক। আশ্চর্যের বিষয়, গত বছর জল স্তর ছিল মাইথনে ৪৬৬ ও পাঞ্চেতে ৪০৬ ফুট। তুলনামূলকভাবে এবার জল কম থাকার পরও ছাড়া হল দ্বিগুণ জল! ডিভিসির প্রাক্তন কর্তা সত্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, বিপদসীমার অনেক নিচে থাকা অবস্থাতেই যদি এত জল ছাড়া হয়, তাহলে উদ্দেশ্যটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

মুখ্যমন্ত্রীর পুরনো ক্ষোভ ফের সামনে, অভিযোগ—‘ডিভিসি বারবার ডুবিয়ে দিচ্ছে বাংলা’

ডিভিসির এই আচরণ নতুন নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেও অভিযোগ করেছিলেন, ‘দক্ষিণবঙ্গে অতিবৃষ্টির মধ্যেই জল ছেড়ে দেয় ডিভিসি। ফলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়।’ গত ১৬ জুলাই তিনি জানান, ১৮ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত মাইথন ও পাঞ্চেত থেকে ২৭ হাজার লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে DVC। তাঁর কথায়, ‘প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েও কোনও কাজ হয়নি।’

ডিভিসির জবাব—‘বাঁধ রক্ষা করতেই এই পদক্ষেপ, রাজ্যকে আগেই জানানো হয়েছে’

ডিভিসির নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ডিভিআরআরসি–র সদস্য সচিব সঞ্জীব কুমার জানিয়েছেন, জল ছাড়ার সিদ্ধান্ত একতরফা নয়। রাজ্যের সঙ্গে প্রতিবার আলোচনা করেই জল ছাড়া হয়। তাঁর বক্তব্য, ‘বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলে বাঁধে অতিরিক্ত জল রাখা নিরাপদ নয়। হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে বাঁধ ভেঙে বিপদ হতে পারে।’ তিনি আরও জানান, DVC নিজেরা জল ছাড়ে না, বরং কেন্দ্রীয় নির্দেশে জল ছাড়া হয়।

জল নেই, অথচ জলাধারে কাদা! বিপন্ন পর্যটন ও নৌচালকরা

মাইথনে গিয়ে দেখা গিয়েছে, জলাধারে জলের পরিমাণ এতটাই কম যে কোথাও কোথাও পাথর, কাদা বেরিয়ে এসেছে। নৌকা চালানোই এখন চ্যালেঞ্জ। পর্যটকদের নিয়ে যাঁরা প্রতিদিন মাইথন ঘুরে দেখান, তাঁদের উদ্বেগ, “এখনই যদি এমন হয়, মার্চ–এপ্রিলে কী অবস্থা হবে? ডিভিসির বোঝা উচিত ভবিষ্যৎ কী অপেক্ষা করছে।” বর্ষার মাঝামাঝি যদি এত জল ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে গ্রীষ্মে কীভাবে চলবে শিল্পাঞ্চল ও চাষাবাদ?

আবহাওয়া স্বাভাবিক, তবু জলছাড়া—DVC সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ছে রাজ্য প্রশাসন

ঝাড়খণ্ডে গত কিছুদিন ধরে আর বৃষ্টি হয়নি। তেনুঘাট বাঁধে পরিস্থিতি স্থিতিশীল। তা সত্ত্বেও কেন এই জলছাড়া? প্রশ্ন উঠেছে, এটি কি কেবল বাঁধ রক্ষা না, অন্য কোনও প্রশাসনিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্বাঞ্চলে গত বছরই ৩৬% কম বৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে জল ধরে রাখাই যুক্তিযুক্ত ছিল।

অতিরিক্ত জলছাড়া না হলে ভবিষ্যতে দুর্দিন অপেক্ষা করছে, হুঁশিয়ারি বিশেষজ্ঞদের

চাষবাস, শিল্পাঞ্চলের জলের যোগান—সব কিছুর জন্য মাইথন-পাঞ্চেতের জলই ভরসা। এখনই যদি অতিরিক্ত জল ছাড়া হয়, আগামী দিনে পশ্চিম বর্ধমান ও বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ অংশে ভয়াবহ জলের অভাব দেখা দেবে। রাজ্য চাইছে, জলছাড়া হোক যৌক্তিক পরিস্থিতিতে, পরিস্থিতি দেখে। অন্যথায় আগামী বছরে পানীয় জল নিয়েও দেখা দিতে পারে বিপর্যয়।

Leave a comment