গান্ধী জয়ন্তী ২০২৫: অহিংসা ও সত্যের প্রতীক মহাত্মা গান্ধীর ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী

গান্ধী জয়ন্তী ২০২৫: অহিংসা ও সত্যের প্রতীক মহাত্মা গান্ধীর ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী
সর্বশেষ আপডেট: 1 ঘণ্টা আগে

২০২৫ সালের ২ অক্টোবর ভারতে মহাত্মা গান্ধীর ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী পালিত হবে। এই দিনটি গান্ধীজির অহিংসা, সত্য ও সরলতার আদর্শ স্মরণ করার এবং তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার সুযোগ করে দেয়।

গান্ধী জয়ন্তী ২০২৫: ভারতের ইতিহাস অনেক মহান ব্যক্তিত্বের কাহিনিতে পরিপূর্ণ, কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর নাম সবচেয়ে স্বতন্ত্র ও বিশেষ। ২০২৫ সালের ২ অক্টোবর সমগ্র জাতি রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধীর ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করবে। এই উপলক্ষটি কেবল একটি জন্মদিনের স্মরণ নয়, বরং এই দিনটি আমাদের গান্ধীজির শিক্ষা, ধারণা এবং তাঁর জীবন থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণা আত্মস্থ করার সুযোগ করে দেয়।

গান্ধী জয়ন্তী কেবল ভারতেই নয়, সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস হিসেবেও পালিত হয়। এটি এই কথার প্রমাণ যে গান্ধীজির প্রভাব সীমানা অতিক্রম করে সমগ্র মানবতার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।

মহাত্মা গান্ধীর জীবন পরিচয়

মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর গুজরাটের উপকূলীয় শহর পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সরলতা, সত্যনিষ্ঠা এবং সততার গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পোরবন্দর ও রাজকোটে সম্পন্ন হয়। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন গান্ধীজি বর্ণবৈষম্য ও জাতিগত বৈষম্যের শিকার হন। এই অভিজ্ঞতাই তাঁর মধ্যে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি জাগিয়ে তোলে। তিনি এখানেই অহিংসা ও সত্যাগ্রহের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা পরে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে ওঠে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীজির ভূমিকা

ভারতে ফেরার পর মহাত্মা গান্ধী ইংরেজদের বিরুদ্ধে একাধিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনগুলি স্বাধীনতার লড়াইকে নতুন দিশা দিয়েছিল।

  • চম্পারণ সত্যাগ্রহ (১৯১৭): বিহারের কৃষকদের শোষণের বিরুদ্ধে গান্ধীজির প্রথম বড় আন্দোলন।
  • অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০): ব্রিটিশ শাসনের বর্জন এবং স্বদেশী জিনিস ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে এই আন্দোলন।
  • ডান্ডি মার্চ ও লবণ সত্যাগ্রহ (১৯৩০): লবণ আইন ভেঙে ব্রিটিশ শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানান।
  • ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২): ইংরেজদের ভারত ছাড়ার আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত মোড় দেন।

এই আন্দোলনগুলি কেবল ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেয়নি, বরং ভারতীয় জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্যের অনুভূতিও জাগিয়ে তুলেছিল।

গান্ধীজির চিন্তা ও দর্শন

মহাত্মা গান্ধী কেবল একজন রাজনীতিবিদই নন, একজন চিন্তাবিদ ও দার্শনিকও ছিলেন। তাঁর জীবনের ভিত্তি তিনটি প্রধান নীতির উপর দাঁড়িয়েছিল:

  1. সত্য (Truth): গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন যে সত্যই ঈশ্বর। তিনি প্রতিটি পরিস্থিতিতে সত্যের পথে চলার শিক্ষা দিয়েছিলেন।
  2. অহিংসা (Non-Violence): তিনি হিংসার বিরোধিতা করেছিলেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের পথ গ্রহণ করেছিলেন।
  3. সরলতা (Simplicity): গান্ধীজির জীবন ছিল অত্যন্ত সরল। তিনি খাদি পরতেন এবং আত্মনির্ভরশীলতাকে গুরুত্ব দিতেন।

তাঁর এই ধারণাগুলি কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামেই কার্যকর প্রমাণিত হয়নি, বরং আজও সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান করে।

বিশ্বজুড়ে গান্ধীজির প্রভাব

গান্ধীজির ধারণাগুলি কেবল ভারতকেই নয়, সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করেছিল।

  • মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (আমেরিকা): তিনি নাগরিক অধিকার আন্দোলনে গান্ধীজির অহিংসার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
  • নেলসন ম্যান্ডেলা (দক্ষিণ আফ্রিকা): বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গান্ধীজি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন।
  • আং সান সু চি (মিয়ানমার): গণতন্ত্র ও শান্তির আন্দোলনে গান্ধীজির শিক্ষা অনুসরণ করেছিলেন।

এটি স্পষ্ট করে যে গান্ধীজির শিক্ষা সীমানা অতিক্রম করে সমগ্র মানবতার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

গান্ধী জয়ন্তীর গুরুত্ব

গান্ধী জয়ন্তী কেবল মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকী নয়, এটি ভারতীয় গণতন্ত্র এবং সামাজিক সচেতনতার প্রতীকও। ২ অক্টোবর সারাদেশে সরকারি ছুটি থাকে এবং এই দিনটি তাঁর আদর্শ স্মরণ করার এবং তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার সুযোগ করে দেয়।

এই দিনে স্কুল, কলেজ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি রচনা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, নাটক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শিক্ষার্থীদের মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও তাঁর অবদান সম্পর্কে সচেতন করা হয়। এই দিনটি বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে শান্তি, অহিংসা এবং নৈতিকতার পথে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করে।

গান্ধী জয়ন্তীতে আয়োজিত কর্মসূচি

দেশজুড়ে গান্ধী জয়ন্তী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। নয়াদিল্লির রাজঘাটে জাতীয় নেতা ও নাগরিকরা মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া, স্কুল ও কলেজে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বৃক্ষরোপণ, রচনা প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

স্থানীয় পর্যায়ে সমাজসেবক ও স্বেচ্ছাসেবকরা এমন কর্মসূচির আয়োজন করেন যা গান্ধীজির আদর্শ—সরলতা, সহযোগিতা ও সেবা—কে তুলে ধরে। অনেক প্রতিষ্ঠান এই দিনে অনাথালয়ে খাদ্য বিতরণ এবং অভাবীদের সহায়তা করার মতো সামাজিক সেবার মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করে।

আজকের প্রেক্ষাপটে গান্ধীজির প্রাসঙ্গিকতা

গান্ধীজির ধারণাগুলি আজও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ছিল।

  • পরিবেশ সংরক্ষণ: গান্ধীজি সরলতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছিলেন।
  • সামাজিক ন্যায়: জাতিভেদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর চিন্তাভাবনা আজও সমাজ সংস্কারের ভিত্তি।
  • বৈশ্বিক শান্তি: যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ দ্বারা প্রভাবিত বিশ্বে গান্ধীজির অহিংসাই স্থায়ী সমাধান।
  • আর্থিক আত্মনির্ভরশীলতা: ‘স্বদেশী ও স্বাবলম্বন’-এর তাঁর নীতি আজ ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর ধারণার সাথে সংযুক্ত।

গান্ধী জয়ন্তীর শুভেচ্ছা ও বার্তা

এই দিনে আমরা প্রিয়জনদের গান্ধীজির উদ্ধৃতি, বার্তা এবং শুভেচ্ছা পাঠাতে পারি। “অহিংসা পরম ধর্ম”, “সত্যের জয় সর্বদা হয়” এর মতো তাঁর বার্তাগুলি জীবনে পথপ্রদর্শক হতে পারে।

গান্ধী জয়ন্তী উপলক্ষে আমরা সকলে এই সংকল্প গ্রহণ করি যে আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তাঁর নীতিগুলি গ্রহণ করব এবং বিশ্বে শান্তি, সহযোগিতা ও সদ্ভাব ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

গান্ধী জয়ন্তী কেবল মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানানোর উপলক্ষ নয়, বরং এই দিনটি আমাদের তাঁর আদর্শগুলিকে জীবনে বাস্তবায়িত করার অনুপ্রেরণা দেয়। অহিংসা, সত্য এবং সরলতার মতো মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিকতা আজও ততটাই, যতটা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ছিল। ২০২৫ সালে তাঁর ১৫৬তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের সংকল্প নেওয়া উচিত যে আমরা শান্তি, করুণা এবং ঐক্যের পথে চলে একটি উন্নত সমাজ ও জাতি গঠন করব।

Leave a comment